Our Concern
Ruposhi Bangla
Hindusthan Surkhiyan
Radio Bangla FM
Third Eye Production
Anuswar Publication
Ruposhi Bangla Entertainment Limited
Shah Foundation
Street Children Foundation
March 29, 2024
Homeসাহিত্যগল্পওলগা তোকারজুকের ‘অন্তিম গল্পগুলো থেকে’ অনুবাদ: বিপাশা মন্ডল

ওলগা তোকারজুকের ‘অন্তিম গল্পগুলো থেকে’ অনুবাদ: বিপাশা মন্ডল

ওলগা তোকারজুকের ‘অন্তিম গল্পগুলো থেকে’ অনুবাদ: বিপাশা মন্ডল

ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত পারাস্কাভিয়া নিজেদের যৌথ জীবনের কথা ভাবছিল, তার পোলিশ স্বামী পেট্রো তখন ঘরের বাইরের তুষারের মধ্যে মৃত পড়ে আছে। ওখানে সে আর পেট্রো বাস করত। সে সময় সোভিয়েট আর্মি অনেক পোলিশ লোককে সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, এখন স্বামীর মৃত্যু নিজের বৃদ্ধাবস্থা এসবের মধ্যে ঐ যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতির ভার আছড়ে পড়ছিল পাস্কাভিয়ার উপরে।

সাত বছর পরে পরে বিয়ের অনুষ্ঠান প্রত্যেক দম্পতির আরেকবার আয়োজন করা উচিত, কারণ মেরিয়াঙ্কা আন্টি প্রায়ই বলতেন – প্রত্যেক সাত বছর পরে তুমি একজন আলাদা মানুষে পরিণত হও। তাই তোমাকে প্রত্যেক ধরনের চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, মর্টগেজ শর্ত, নথিভূক্ত তথ্য, এবং ব্যক্তিগত পরিচিতি কে নবায়ন করতে হয়। যে কোনো কাগজপত্রকে।

আমার স্বপ্নের মধ্যে পেট্রো দ্বিগুণ এবং তিনগুণ বেশি বয়সী, এক মুহূর্তে ও তরুণ, পরের মুহূর্তে ও বৃদ্ধ। এক মুহূর্তে ও আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করছে, পরের মুহূর্তে ও আমাকে আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলছে। আজকের স্বপ্নে ও ওর নোংরা চায়না কাপে করে গরম চা পান করছে। চা থেকে বাষ্প উঠছে, আর ওর ভ্রুতে বাষ্পের বিন্দু জমছে। এরপর জলীয়বাষ্প জমে গেল এবং লম্বমান তুষার কণায় বদলে গেল, তাই ও আর চোখ খুলতে পারছে না। ও আমার কাছে একজন অন্ধের মতো এসে হাজির হল আর আমাকে বলল তার চোখ থেকে বরফ টুকরো গুলো সরিয়ে দিতে। যেন ও দেখতে পারে। অসহায়ভাবে আমি রান্নাঘরের চারপাশে তাকালাম যদি কোনো বিশেষ হাতিয়ার খুঁজে পাই। ও বলছিল “বরফমুক্ত করার যন্ত্র” অথবা ওরকম কিছুই, আর ড্রয়ারের দিকে ইঙ্গিত করছিল। এর মানে হচ্ছে ওখানে এমন একটা হাতিয়ার আছে যেটা চোখ থেকে বরফ সরাতে পারে, এবং সেরকম একটা কিছু ও পেয়েছে। ও যে কোনো কিছু করার জন্য তৈরি।

এছাড়াও আমার ও পেট্রোর মধ্যে আরেকটা পার্থক্য আছে, এবং আমি এটাকে মনে মনে গোণায়ই ধরতাম না। সম্পর্কের শুরুর দিকে পার্থক্যর বদলে তুমি সবকিছুতে মিল ই খুঁজবে। তুমি সারাদিন ধরে সব বিষয় নিয়ে কথা বলে যাবে এবং আবিষ্কার করবে “আমিও এমন”, “এটা একেবারে আমার জন্যও একই রকম”। কিন্তু শেষটা আলাদা। তোমাদের মিলগুলো ছিল আসলে এক সরল প্রতারণা।

ও জানতই না কী করে মজা করতে হয়; হয়তো সেকারণেই ওকে আমার কাছে বুড়ো মনে হত, যদিও যখন প্রথম আমার সঙ্গে ওর দেখা হয় ওর বয়স পঁচিশও হয় নি। এমনকী যখন সে নিজের বিয়েতে নাচছিল ও যেন দায়িত্বই পালন করছিল। হ্যা, নাচাটা তাকে আনন্দ দিচ্ছিল, কারণ নাচতে হবে। কিন্তু এই নাচ ছিল যান্ত্রিক। যা কিছুই ও করতো, ও শুধু ওটাই করতো আর কিছু নয়। যখন সে কাঠের দেয়ালের গায়ে রঙ করতো, ও শুধু রঙই করতো। যখন সে ছাত্রদের পরীক্ষার খাতায় নম্বর দিত, শুধু নম্বরই দিত। যখন সে লেংচাতো, সে শুধু খোঁড়াতই কারুর এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হত না। যখন সে নীরব থাকত, তখন ও ঠিক যেন একজন বোবা ব্যক্তি। এক জায়গায় সবসময়ে থাকাটা খুবই কৌতুককর, আবার একই সময়ে সব জায়গায় থাকাটাও, গৃহহীন একটা কুকুরের মতো সবসময়ে সম্পৃক্ত থাকা, তুমি যেখানে আছে সেখান থেকে এক মিলিমিটারও না সরে না যাওয়া অথবা বাইরের দিকে একবারও চোখ না রাখাও সমান কৌতুকের।

আমি ছিলাম সম্পূর্ণ বিপরীত; আমি কখনো একটা জায়গায় স্থির থাকতাম না, কেউ আমার নাগাল পেতো না। আমি সবসময়েই মজা করতাম। আমি ঘর ঝাড়– দেবার সময়ে এবং আলুর খোসা ছাড়ানোর সময়ে খেলতাম – আমি এমন ভাব করতাম যেন এসবই একটা খেলা। এখন আমি একটা খেলা খেলছি যেখানে পেট্রো মারা গেছে এবং চত্বরের মধ্যে বরফ জমে শক্ত হয়ে গেছে, আরো ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি কখনো কোনোকিছুকেই অত গুরুত্বের সঙ্গে নিইনি। এখন আমি বরফমাঝের চিঠি গুলোকে পায়ে দলে মজা নিচ্ছি


মেরিয়াঙ্কা আন্টি এটাও প্রায়ই বলতেন প্রত্যেকদিন ঠিক সূর্যাস্তের পরে, পুরো পৃথিবী শেষ সময়টিতে তিন মিনিটের জন্য আকাশ-নীল হয়ে যায়। এসময়ে তুমি যদি চট করে একটা ইচ্ছার চিন্তা কর আর সঙ্গে সঙ্গে দেখো যে পৃথিবী আকাশ-নীল হয়ে গেছে, তখন সে ইচ্ছাটা সত্যে রূপান্তরিত হবে। আমি এখন জানালার ভিতর দিয়ে বাইরে দেখতে পাচ্ছি যে- পৃথিবী আকাশ-নীল হয়ে গেছে। এবং আমি আশ্চর্য নির্ভার হয়ে এও দেখলাম যে আমার কোনো ইচ্ছা নেই।

প্রথম দিকে রাশিয়ানরা রাতের দিকে আসত, তাদের ট্রাকের একঘেয়ে শব্দের পিছনে লুকিয়ে। পেট্রো নিজের কানকে রেডিওতে চেপে ধরে গোঙাতো।

কয়েকটি দিন প্রথমদিকে একেবারে ফিসফিসানিতে ভর্তি ছিলো। লোকজন কানাকানি ছাড়া কিছুই করতো না। এই ফিসফিসানি, গমের ক্ষেতের উপর দিয়ে নিচু হয়ে, গ্রামের মধ্যে উড়ে বেড়ালো এবং ধীরে ধীরে চিমনি থেকে বেরোনো ধোঁয়ার মতো ভেসে চললো। এরপর সব ঠান্ডা হয়ে গেলো। রেডিও স্টেশনকেই তারা প্রথম দখল করেছিল। তখন মানুষকে বাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে হতো। তারা তালিকা করা শুরু করল, সব বিষয়গুলো লিখে নিল এবং সাজালো। এরপর তারা সামরিক বাহনে চড়ে গ্রামের মধ্যে সেপ্টেম্বরের ধূলোয় তৈরি হলুদ মেঘ উড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।

পেট্রো তার চাকরি হারালো। রাত্রিবেলা শোনা যেতো স্কুলের মাঠে লোকগুলো হল্লা করছে, স্কুলটা দখল করে সেখানে তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছে – তারা দেয়ালে গুলি ছুঁড়ে টার্গেট প্রাক্টিস করতেই থাকল, নিউটন ও কোর্পানিকাসের ছবিতেও গুলি ছুঁড়ল।

এখন এটা স্পষ্ট যে তারা পোলিশদের তাড়িয়ে দেবে। আমি মায়রনের কাছ থেকে এটা জেনেছি। সে কিন্তু আসলে অন্যকিছু বলে ঐ বিতাড়নের বিষয়টি বুঝিয়েছিল। সে এরকম বলেছিল: “ঠিকঠাক সেবা কর। তুমি একজন বুড়ো লোককে বিয়ে করেছো, এবং এখন তার সঙ্গে সঙ্গে মরুভাল্লুকের দলে যোগ দেয়া থেকে বিরত থেকো।” অথবা এটা মেরিয়াঙ্কা আন্টিই ছিলেন, যিনি খবরটি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন তা আসলে ছিলো : “কিছু একটা করো। যদি তোমরা নিজেদের এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাও তোমাদের দুজনকেই এটা করতে হবে।” শুধু এই ঘটনাটির ক্ষেত্রে, যখন পেট্রো বাইরে ছিলো, আমি দেয়াল থেকে ধর্মীয় আইকন খুলে নিলাম এবং সেজায়গাটিতে খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া স্তালিনের একটা ছবি ঝুলিয়ে দিলাম।

এরপর তারা আমাদের কাছাকাছি কয়েকজন বেসামরিক রাশিয়ানের ঘর তৈরি করে দিল। তারা ছিল ডাক্তার। ঐ দিন থেকে আমাদের রান্নাঘর তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হচ্ছে, যেটাকে পেট্রো সহ্য করতে পারে নি। ও সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের শোবার ঘরে বসে বসে কাটালো এবং যখন ওরা দুজন রান্নাঘর ছেড়ে যেত কেবল তখনই ঘর থেকে বের হতো- ও এসব করত শুধু ঐসব রাশিয়ানদের মুখ দেখতে চায় না বলে। আসলে কিন্তু তারা বেশ ভালো লোক ছিল। আমরা যদিও একে অপরকে ততটা ভালো করে বুঝতে পারিনি, কিন্ত যোগাযোগ করতে আসলে কতগুলো শব্দেরই বা দরকার হয়? নারীটি ছিল ছোটোখাটো এবং সুন্দরী, একটা প্রশস্ত মুখমণ্ডল আর ফোলা ফোলা একজোড়া ঠোঁট, ঠিক একটা ছোটোখাটো নেউলের মতো। একদিন আমরা যখন পোশাক সম্পর্কে কথা বলছিলাম, একে অন্যের ঘাগড়ার কাপড় কেমন তা দেখছিলাম আর একে অন্যের ব্লাউজের ঘাড়ের পট্টি স্পর্শ করছিলাম, আমি আবিস্কার করলাম যে লাইবা নামের এই মেয়েটি, কোনো অর্ন্তবাস পরেনি। যুদ্ধের জন্য তারা প্রচুর বন্দুক আর রকেট লাঞ্চার উৎপাদন করেছে কিন্তু কোনো জাঙিয়া তৈরি করেনি। যখন আমরা একে অন্যের পোশাকগুলো অদলবদল করে পরার চেষ্টা করছিলাম, আমি বিস্ময়াহতভাবে একঝলক তার নগ্ন নিতম্ব দেখে ফেললাম এবং তার আশ্চর্যজনক সুস্পষ্ট লোমময় ছোট প্রত্যঙ্গ।

অর্ন্তবাস। তখন পর্যন্ত তাদের মনে হয়নি যে এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- তারা এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতেও পারত না। যদিও এটা এভাবে পাল্টে গেল যে আমরা যে জাঙ্গিয়া পাচ্ছি তাকে তারা ধন্যবাদ দিচ্ছে। পেট্রোর বাবা মা আমাকে বিয়ের সময় উপহার হিসেবে যে সেলাই মেশিন দিয়েছিলেন, আমি সেই মেশিন দিয়ে অফিসারদের স্ত্রীদের জন্য জাঙিয়া সেলাই করতে শুরু করলাম। আমি কিছু কাগজের সৌখিন ডিজাইন কেটে নিলাম, এবং প্রত্যেকদিন আমি ফুল আঁকা বিশেষ দামী কাপড়, পিছল সাটিন, আর সাদা থান কাপড় ছাড়াই, সাধারণ কাপড়ে ডজনের পর ডজন জোড়ায় জোড়ায় জাঙিয়া তৈরি করতে শুরু করলাম। লাইবার স্বামী, ফিওদর ইভানোভিচ, তাদের ব্যবহারের জন্য বাদামী কাগজে পেচিয়ে সংগ্রহ করতেন, এরপর আমাদের ঘরে টাকা, মদ এবং চা নিয়ে আসত এর মূল্য হিসেবে। আমার জীবনে এই প্রথমবারের মত আমি নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য অর্থরোজগারের কাজ করছিলাম। আমরা ট্রাসকাওইস এ যাবার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম, এবং এখন আমিই তাকে আইসক্রীম খাবার জন্য বাইরে আমন্ত্রণ জানাতে পেরেছিলাম- এসব সুখ ঐশ্বর্য খুব সাধারণভাবে আমাদের হাতে এসে ধরা দিচ্ছিল। দোকানগুলো তখনও খালি হয়ে যায় নি, তাই আমি নিজের জন্য চমৎকার কিছু গ্রীষ্মকালের জুতো কিনেছিলাম আর কিনেছিলাম একবোতল সুগন্ধি। আমার কাছে এখনো সেই পারফিউম লেউইনের বোতলটি আছে; যদিও খালি, এটা এখনো সেই স্মৃতির গন্ধ নিয়ে বিঁধে আছে, তার মানে এটা আমার পৃথিবীর অর্ধেক ঘুরে এসেছে আমার সঙ্গে, শান্তভাবে আমার ড্রেসিংটেবিলের উপরে বসে আছে, অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেখানে পথের মধ্যেই কোথায় হারিয়ে গেছে। কালো আবলুশ কাঠের ছিপিওয়ালা ঐ বেঁটে খাটো বোতলটি ভালোভাবেই টিকে গেছে, কিন্তু আমার শিশুটি টেকেনি।

ঐ জাঙিয়াগুলো আমাদের বোধকে নিস্তেজ করে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম জাঙিয়াগুলোই সবকিছুর চাবি, তাই এ জাঙিয়ার ব্যবসার সাফল্য উত্তরোত্তর বাড়তেই লাগল, আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হওয়া থেকে বাঁচালো। এমন গুজব শোনা যেতে লাগলো যে সকল সদস্যসহ পরিবারগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, ট্রাকগুলো তাদের জন্য একেবারে ভোররাতে চলে আসে এবং তাদের নিয়ে পূর্বদিকে নিয়ে যায়। যদিও আমাদের গ্রামে এমন কিছু ঘটেনি, হয়তো সৈনিকেরা এ গ্রামের স্কুলে ঘাঁটি গাড়ার কারণে বেচে গেছে, বেড়ার ঠিক অন্য দিকে, কিন্তু হয়তো এটাও সত্যি যে কেউ বৃক্ষের ভিতরকার কাঠ কে দেখতে পায় না। প্রথমে আমি সবসময়ে বেড়ার বাইরের ঐ শয়তানদের আবাসের উপরে একটা চোখ রাখতাম, বাগানে কাজ করার ছুতোয়, যেমন পাম গাছগুলোর মধ্যে ধোয়া জিনিস ঝুলাতাম শুকানোর জন্য। আমি দেখতাম সৈনিকেরা তালে তালে দৌড়ে যাচ্ছে এবং দালানটির মধ্যে অদৃশ্য হচ্ছে, এরপর আবার তারা দালানটা থেকে দৌড়ে বের হতো, জিপের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তো এবং মহা আড়ম্বরে চলে যেত। আমি তাদের মুখগুলোকে পড়তাম এবং তাদের কাঁধে লটকানো পদমর্যাদা অনুসারে তাদের স্মরণ রাখার চেষ্টা করতাম। তারা খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলো। এখন যখন আমি ওটা বিষয়ে চিন্তা করি- “ঘুম” নামক শব্দটা আমাকে পেয়ে বসে, আর তারা নিজেদের বিষয়ে এতোটাই নিশ্চিত ছিলো যে তারা যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তারা আমাকে বলেছিল কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা সকলে তাদের নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে একটা খেলা খেলছিল।

কিন্তু এদের মধ্যে একজন, কোনোরকম দুঃস্বপ্ন ছাড়াই, কাঁধের তারাগুলো দিয়ে বোঝাতো, সে এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটা আসলে দুজন ব্যক্তি, দুজন অফিসার, একই রকম হাঁটার ভঙ্গি, আর একটা কালো হাতমোজার মধ্যে একটা নকল হাত। যখন সে স্কুলের মধ্যে ঢুকে যেতো তখন সে একজন লোক, যখন সে বের হয়ে আসতো, তখন সে অন্য লোক। কেবল পরবর্তীকালে, যখন আমি তাকে মুখোমুখি দেখেছি, এবং আমাদের দৃষ্টি মিলেছে, আমি তখন সত্যটা বুঝতে পেরেছি : তার মুখের বামদিকটা প্রাণহীন, ক্ষতচিহ্নে বিকৃত যেটাতে একটা বেদনাদায়ক ভেংচানো মুখ বোনা আছে। তার বাম হাত কাঠ দিয়ে তৈরি, এবং তার বাম পা পেছনে লেংচে চলে, ঠিকভাবে পদক্ষেপ ফেলতে পারে না। তাই যখন সে স্কুলের মধ্যে ঢোকে তখন আমি তার ডানদিকটাই দেখি – একটা তারুণ্যউজ্জীবিত মুখ, উজ্জ্বল চোখ, একটা মসৃণ খাড়া নাক, আর একটা হাত তার ঠোঁটে সিগারেট ধরে আছে। কিন্তু যখনই সে স্কুলবাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে সে যেন এক স্তূপ ব্যথা, প্রকৃতির এমন একটা সৃষ্টি যে পৃথিবীর প্রান্তে আশ্চর্যভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সবকিছু সত্ত্বেও, সে বেঁচে থাকবেই।

আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর ছাপার পোশাকটি পড়লাম, রক্ত-লাল করে রাঙালাম আমার ঠোঁট, এবং স্কুলের ভিতরে গেলাম। আমি জানতাম না, আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবার জন্য, ঐ দ্বৈত মানুষটিকে আমি কী করে জাদু করবো বা আকর্ষণ করবো অথবা কী বলবো।

এভাবেই আমি ইউরি লিবারম্যানের সঙ্গে মুখোমুখি হলাম। সে বসেছিলো এবং আমি দাঁড়িয়েছিলাম। খাপরার চুলার দিকে তাক করা নলের একটা পিস্তল টেবিলের উপরে শোয়ানো ছিলো। আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম, ঘরে ঢোকা মাত্রই, যে আমার স্বামীর একটা পোলিশ উপাধি হয়তো আছে, কিন্তু সে পোল নয়, এজন্যই আমরা দুজনেই ইউনিয়েট চার্চের অনুসারী, এবং আমরা আজ যেহেতু ভালো কাজ করছি, যেহেতু আমি একজন ভালো ঘর রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং আমার স্বামী একজন করিৎকর্মা লোক, তাই কিছু লোক হয়তো আমাদের বিষয়ে হিংসাত্মক হয়ে আমাদের সম্পর্কে নানারকম বাজে গল্প শোনাতে পারে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমি ঠিক একটা ছোট বালিকার মতোই কথা বলছিলাম – এই সব মিথ্যা কথার কলাকৌশল ছিলো করুণা উদ্রেককারী। সর্বোপরি তাদের কাছে সেকশনের দলিলপত্র ছিলো. যেটার মধ্যে সুস্পষ্ট লেখা ছিল আমাদের বিষয়ে। “লোকজন তোমাদের অপছন্দ করতে বাধ্য। তোমরা এতটাই দুর্বিনীত,” সে রাশিয়ান ভাষায় এসব বললো এবং তার মুখমণ্ডলের সুস্থ অর্ধেক অংশ মৃদু হাসলো। আর বাকী অংশ থাকলো অভিব্যক্তিহীন।

আমি এই দু’রকম মুখের ভাবকে অনুবাদ করার চেষ্টা করছিলাম, যে আমাদের বিষয়ে ঠিক কথা থাকতে পারে হবে ফাইলের মধ্যে। একজন লোক দরজায় কড়া নাড়ল এবং ভিতরে ঢুকল, টেলিফোন বেজে উঠল, এবং হঠাৎ করে লেফটনেন্ট লিবারম্যান অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবং আমার দিকে মনোযোগ দেয়া একেবারে বন্ধ করে দিল। আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম এবং দরজার দিকে পিছু হটে গেলাম। যখন সে ঘরের মধ্যে রিসিভার নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো আমি তখন তার মুখের এপাশ ওপাশ একবারে দেখতে পেলাম। আমার জুতো, পা এবং পোশাকে সম্মিলিতভাবে সে তার চোখের দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো।

“সন্ধ্যার দিকে একবার আসবে। আমার কাছে এখন কোনো সময়ই নেই,” আমাকে এটা বললো আর ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলো।

আমি পেট্রোকে বললাম যে আমি মেরিয়াঙ্কা আন্টির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে যখন ও লালকার সঙ্গে রান্নাঘরের মেঝেতে খেলছিলো, ওর অলক্ষ্যে আমি কিছুটা ভদকা পান করে নিলাম।

আমি বেড়ার কাছ দিয়ে অলক্ষিতে ঢুকে পড়লাম, চাঁদের ছায়ায় একটার পর একটা ঝাঁপ দিয়ে এগোলোম। আমি অনুভব করলাম যে আমার খুব গরম লাগছে, এবং আমার বাহুর নিচে পোশাকটা ঘামে একেবারে ভিজে গেছে। সেন্ট্রি আমাকে স্কুলের ভিতরে ঢুকতে বাধা দিল; লোকটা তার রাইফেলটি আমার দিকে তাক করল এবং রাশিয়ান ভাষায় বলল : “চলে যাও, হতভাগা নারী,” তাই আমি একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, পা বদল করলাম, এবং জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যখন আমার হাতের নিচে জামা শুকিয়ে গেলো আমি কাঁপতে শুরু করলাম। “গোল্লায় যাও আর জাহান্নামে যাও লিবারম্যান, বলভেশিক,” আমি এসব ক্রোধান্বিতভাবে আমার নিশ্বাসের মধ্যে নিজেকে এগুলো বললাম, আমি যখন বাড়ি ফিরে যাবার জন্য উল্টো ঘুরেছি তখনই আমি লিবারম্যানের মুখের মৃত অংশটিকে জানালায় দেখলাম। সে আমাকে দেখতে পেল না; সে তখন চাঁদের দিকে দেখছে। তার জন্য হয়তো এটা একটা আয়নার দিকে তাকানোর মতোই- চাঁদ ও তার, দুজনেরই দুটো করে মুখ।

কাঁপতে কাঁপতে, আমি ছায়া থেকে বেরিয়ে এলাম। জানালার মুখটি ঝট করে আমার দিকে ফিরল এবং অদৃশ্য হয়ে গেলো। শীঘ্রই সে সিঁড়িতে দেখা দিল এবং অপেক্ষা করতে থাকল। সেন্ট্রি এমনভাব করল যে সে আমাকে আগে কখনো দেখেনি। লিবারম্যান আমাকে স্কুলের করিডোরে নিয়ে গেলো এবং সিঁড়িতে উঠতে বললো, এটা সেই এপার্টমেন্টে যেখানে পেট্রো আর আমি বিয়ের ঠিক পরেই ঘর বেঁধে ছিলাম। ঠিক একটা স্বপ্নের মতোই সে আমাকে সেই ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলো। যেখানে আমাদের পুরনো শোবার ঘর, আমি এই মেঝের প্রতিটা উচুনিচু বাঁক চিনি, চিনতে পারি দেয়ালের প্রতিটি দাগ। আমাদের নতুন বাড়ির জন্য অনুপযোগী, একেবারে ঝরঝরে জীর্ণ হওয়ায় আমাদের সেই ডাবল বেডের খাট আর নেওয়া হয়নি, তাই এখনো তা এখানে রয়ে গেছে। লিবারম্যান আমাকে সেই খাটটার উপর বসতে বলল। “নাম কি তোমার?” জিজ্ঞাসা করল সে, যেন তিনি ধীরে ধীরে এবং নিয়মানুগভাবে কাপড় ছাড়ছে, তার কাপড় খাটের লম্বা স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখছে। আমি জবাব দিলাম, আমি তাকে পেট্রোর সবকিছুও জানালাম জন্মতারিখ সহ। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি যে লেফটনেন্ট লিবারম্যানের পুরো বামদিকের হাতটা অনড়- তার বাম দিকের বাহুটা প্রাণহীনভাবে তার শরীর থেকে ঝুলছে এবং এবং এটা শেষ হয়েছে একটা নকল পা-এ, যেখানে তার বাম পা টা একধরনের ক্যালিপার দিয়ে বেড়ি পরানো যেটা চাঁদের আলোতে চকমক করছে। সে আমার সামনে কোনো লজ্জা পেলো না, যেন আমি কোনো মানুষ নই।

যখন সে আমার উপরে উপগত হলো, আমি কল্পনা করছিলাম যে আমি শুধুমাত্র তার জীবিত অর্ধেকের সঙ্গে চুক্তি করতে পারি। তার শরীর ছিল ক্ষিপ্র এবং আত্মবিশ্বাসী। এরপরে সে আমাকে বলল যে আমি সুন্দরী, কিন্তু একধরনের ধরাবাধা সুরে, কারণ সে আমার দিকে তাকায়ওনি- এর চেয়েও বেশি যেন সে অনুভব করছিলো স্কুলশিক্ষকের শোবার ঘরের কাগজের তৈরি দেয়ালের মাঝের খালি জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে কিছু একটা দাঁড় করাতে হবে।

আমি যখন বাড়ি ফিরে এলাম, পেট্রো আর শিশুটা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বেসিনের মধ্যে কিছুটা পানি নিলাম আর অন্ধকার রান্নাঘরে নিজেকে ধুয়ে ফেললাম। আমি ঘেন্নায় কেঁপে উঠলাম, যেটা আমার পাপবোধকে কমাতে লাগলো। কিন্তু তখনই সঙ্গে সঙ্গে একটা অসহনীয় লজ্জামিশ্রিত আকস্মিক তীব্র বেদনা আমাকে চেপে ধরল। এটা নিয়ে ভেবো না, পাতলা ঠোঁটের পারাস্কাভিয়া তোমার লাল পোশাকের ভিতরে। ঘেন্নার আগুন তার সীমার মধ্যেই স্তিমিত হচ্ছে।

আমি আরো কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, এবং এটাকে আত্মউৎসর্গ বলা যেতে পারে। একটা পঙ্গু পুবদেশিয় স্বৈরশাসক, নিজের চাহিদার জন্য অনিশ্চিত, যে কোনোকিছুর জন্য তৈরি। এটা যখন ঘটত আমি আমার চোখ বন্ধ করে থাকতাম, আর চেষ্টা করতাম আমার মুখটাকে ইতর দেয়ালটার দিকে ঘুরিয়ে রাখতে, কিন্তু সে মুখটাকে টেনে নিজের দিকে ঘোরাতো। সে চাইত আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এরপর আমি তার কাছে কাকুতি মিনতি করতাম, সিগারেটের গন্ধ যেটা তার বিজাতীয় শত্রু পোশাকে লেগে থাকত, তার প্রত্যেকবার মুখ ঘোরানোতে আশ্চর্যভাব থাকতো। সে ছিলো জীবিত ও মৃত, প্রেমপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর। সে আমার সঙ্গে ঘুমাতো, এরপর লোকজনকে মৃত্যুদণ্ড দিতো। তার ক্ষমতা ছিলো বীভৎস, বিষধর ক্ষুদ্র সাপের মতোই ঘনীভূত, তা সত্তে¡ও, আমি এরকম কামনা অনুভব করতাম, এটাকে যদি বশ্যতাস্বীকার করানো যেতো, গলিয়ে ফেলা যেতো, যদি একটা নিশ্চল অবস্থায় আনা যেতো এবং কোনো একটা ইঙ্গিতের মধ্যে দিয়ে যদি এই প্রয়োজন থেকে মুক্ত করে ফেলা যেতো। একদিন আমি স্ট্যাডনিকা ও তার পিতামাতা, রুকিনস্কি এবং আরো কিছু প্রতিবেশিকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য লিবারম্যানকে একটা সামরিক যানবাহনে পৌঁছাতে দেখলাম। সে আমাকে একটা পাখির কথা স্মরণ করিয়ে দিলো, কারণ তার চোখ ছিলো শুন্য, ঠিক একটা মোরগের মতো। তারা বলছিলো রাশিয়ানরা আবেগীয় এবং ভাবালু। এই লোকটা একেবারে ভিন্নরকম। সে হয়তো আসলে কোনো মানুষই নয়। “কে আপনি?” আমি প্রায়ই তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, অথবা “কী হয়েছিলো আপনার সঙ্গে?” তার বুকে আঙুল দিয়ে দীর্ঘ রেখা টানতে টানতে তাকে জিজ্ঞাসা করতাম। সে মৃদু হাসত এবং সিগারেট খুঁজত, কিন্তু কখনো আমাকে কিচ্ছু বলেনি।

রান্নাঘরের জানালা থেকে আমরা দেখতাম সুটকেস আর বাঁধাছাঁদা নিয়ে লোকজন হেঁটে চলেছে, একটা আশাহীন সারিতে। এটা বড়জোর খুব সকাল ছিলো। আমি ঘুমন্ত লালকাকে আমার কোলে নিলাম। পেট্রো একটা সিগারেট টানছিলো। আমাদের বাড়ির দরজার উপরে রক্ত দিয়ে কোনো অভিভাবক ফেরেশতার নাম লেখা আছে কি? ইউরি লিবারম্যান গাড়ির মাঝে বসে ছিলো, তার সেই মুখাংশটুকু দেখা যাচ্ছে যেখানে কখনো কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয় না। “কী হয়েছে? আমরা কেন নই? আগামীকাল নিশ্চয়ই আমাদের পালা আসবে।” “আগে বা পরে সে নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বের করবে,” ভাবছিলাম আমি। এরপর আরো বেশি করে হতোদ্যম হয়ে পড়লাম, সারা দিন ধরে পেট্রো জিজ্ঞাসা করে গেলো: “আমি কেন নই?”

আমি শিঘ্রই বুঝতে পারলাম আমি গর্ভবতী। আমি মেরিয়াঙ্কা আন্টিকে দেখতে গেলাম আর সবকিছু খুলে বললাম। তিনি আমাকে মুখের ওপর খুব পেটালেন, এরপর আমাকে পাশের গ্রামে নিয়ে গেলেন, সেখানে ম্যাট্রোয়েনা নামের একজন বৃদ্ধা নারী আমার গর্ভপাত করালো। আমি রাত্রিভর মেরিয়াঙ্কা আন্টির বাড়িতে থাকলাম এবং তিনি পেট্রোকে বলে এলেন যে আমি অসুস্থ। আমি গত একমাস ধরে অসুস্থ। মেরিয়াঙ্কা কখনো আমাকে একা ছাড়েননি, কারণ আমি মরতে চেয়েছিলাম, আমি চেয়েছিলাম স্বর্গীয় কর্মফল আমার উপরে নেমে আসুক। তিনি ভাবছিলেন আমি বাচ্চাটা হারিয়ে অনুতাপ করছি। কিন্তু আমি আকুলভাবে মরতে চেয়েছিলাম।

একজন রাশিয়ান সৈনিক এলো, মেরিয়াঙ্কা আন্টির সঙ্গে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বললো এবং চলে গেলো। তিনি আমাকে বলেন নি যে লিবারম্যান কি চাইছে। তিনি শুধু পেট্রোর সম্পর্কে বলছিলেন : “তোমার অবশ্যই পেট্রোকে ভালোবাসতে শেখা উচিত, এমন ভাবে ভালোবাসবে, যেন সে তোমার চেয়ে দুর্বল কেউ, শক্তিশালী নয়।”

এরপর কমান্ডাররা অন্যান্য জায়গায় বদলী হলো, কিন্তু কেউ জানে না কে কোথায় গেলো। কিছুদিন পরে মেরিয়াঙ্কা আন্টি আমাকে লিবারম্যানের কাছ থেকে আসা একটা ছোট প্যাকেট দিলেন, যেটাকে ঐ সৈনিকটি নিয়ে এসেছে। এটার মধ্যে একটা ঠিকানা লেখা ছিলো, রাশিয়ান ভাষায়, এক টুকরো ধূসর বাতিল কাগজে, একটা ক্রশ সহ সোনার চেন, কিছু সোনার আংটি, এবং একটুকরো ধাতু যেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সৈনিকের শার্ট থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। আমি এসবকিছুই একটা কাগজে মুড়িয়ে বাগানের একটা পামগাছের নিচে মাটিচাপা দিলাম। আমার জন্ম না নেয়া বাচ্চাটার জন্য একটা বিলম্বিত কবর।

এখন অবধি আমি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাই- লিবারম্যানের বিশাল বড় পায়ের আঙুল, কিছুটা এবড়োখেবড়ো আঙুলের নখ; দ্বৈত মুখের লোকটির সকল শক্তি এখানে অবসন্ন হয়ে আসে, এখানে, এই পায়ের আঙুলের মধ্যে, যেটা ধীরে ধীরে উপরিতলের এবং উপহাস্পাদ্য হয়ে আসে। আমি ওই পায়ের আঙুল নিয়ে লজ্জিত। আমি তার ফাইল ঢাকা টেবিলে প্রেমাবেগপূর্ণ ভালোবাসা করার জন্য লজ্জিত নই, অথবা যে আনন্দের জোয়ার ভেসে আসতো এই প্রেমের জন্য সেই আনন্দের জন্যও লজ্জিত নই, যদিও আমি ঘেন্না ছাড়া কিছুই অনুভব করতে পারি না। সাদা চোখে দেখার পিছনে কতোকিছুই না লুকানো থাকে।

পরবর্তী কয়েকমাসের মধ্যে ইউক্রেনীয়রা তাদের ছেড়ে যাওয়া বাড়িগুলোতে ফিরে এসেছিলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের আত্মীয়, হোরোডোস্কি অথবা কোজোভিচ, কিন্তু তারা আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো, আগে তারা যেটা কখনো করতো না। আসলে হোরিডিস্কির একজন পোলিশ স্ত্রী আছে, যেটা একজন পোলিশ পুরুষকে স্বামী হিসেবে পাবার চেয়ে ভালো। যা হোক নারীরা ততটা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, যদিও তাদেরও দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে হয়। মোটের উপরে, সমগ্র জাতিগোষ্ঠি তাদের পেট থেকেই জন্ম নিয়েছে।

“বলো আমাকে, এসব গুজব কি সত্যি?” পরবর্তীতে পেট্রো আমার চোখে চোখ রেখে কঠোরভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল।

“না, এই সব কিচ্ছু নয়,” বলেছিলাম আমি।

...

[ওলগা তোকারজুক: উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক ওলগা তোকারজুক ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। ২০১৮ সালে জিতে নেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। তিনি পোল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। এরপর অনেক বছর নীরব থাকার পরে তিনি আবার ১৯৯৩ সালে তার উপন্যাস দি জার্নি অব দি বুক পিপল (১৯৯৩) নিয়ে পাঠকের মাঝে হাজির হন। যে বইটি পাঠকের মাঝে ইতিবাচক সাড়া ফেলে। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস ফ্লাইট। ২০১৮ সালে এই বইয়ের জন্য তিনি ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। “অন্তিম গল্পগুলো থেকে” গল্পটি পোলিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এন্টোনিয়া লয়েড-জোনস। গল্পটি একটি ইংরেজি ওয়েবম্যাগে ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে।]

Share With:
Rate This Article
No Comments

Leave A Comment