চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১ হাজার ৭শ’র বেশি চিকিৎসাকর্মী
চীনে করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবার আরেকটি দিক উন্মোচিত হলো এবার। দেশটিতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি চিকিৎসাকর্মী। তাদের মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন।
গতকাল শুক্রবার চীন সরকার এ তথ্য প্রকাশ করেছে। এদিকে এদিন দেশটিতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে আরও ১২১ জনের। ফলে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮০ জনে। এ রোগে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন আরও অন্তত ৫ হাজার ৯০ জন। এতে আক্রান্তের সংখ্যা ঠেকেছে ৬৩ হাজার ৮৫১ জনে।
এ পরিস্থিতিতে চোখের সামনেই স্বজনের অসহায় মৃত্যু দেখতে হচ্ছে অনেককে।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের উপপরিচালক জেং আইজিন জানান, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হুবেই প্রদেশের উহানে ১ হাজার ১০২ জনসহ দেশটির ১ হাজার ৭১৬ চিকিৎসাকর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তারা হাসপাতালে নাকি বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন তা নিশ্চিত নয়। এটা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাব খুবই উদ্বেগজনক তথ্য। এটা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, হুবেইয়ের চিকিৎসাকর্মীরা দিনরাত কাজ করে চলছেন। উপরন্তু তারা মাস্ক, গাউন ও সেফটি গগলসসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সামগ্রী পাচ্ছেন না। অনেক ডাক্তার ও নার্স জানিয়েছেন, টয়লেটে যাওয়া এড়াতে তারা দৈনিক মাত্র একবার আহার করেন। কারণ, টয়লেটে গেলে গাউন পরিবর্তন করতে হয়। অথচ তাদের কাছে বিকল্প গাউন নেই।
চীনে ২০০৩ সালে সার্সের প্রাদুর্ভাবের সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন ৯৬১ চিকিৎসাকর্মী।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, করোনাভাইরাসে দেশটির যে ফাঁকফোকর ও দুর্বলতা ধরা পড়েছে তা সারাতে হবে। এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীনের অর্থ মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে।
কীভাবে এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা হবে, কীভাবে চীনে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে এখনও দিশেহারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চীনের স্বাস্থ্য দপ্তরও খেই হারিয়ে ফেলছে। সরকার উচ্চপদস্থ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। নতুন যারা এসেছেন, তারাও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত ২৫টি দেশ থেকে সংক্রমণের খবর মিলেছে।
অপেক্ষাকৃত গরিব দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে গেলে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে। গতকাল সেই আশঙ্কা আরও বেড়েছে। উত্তর কোরিয়ায় ক্রমশ এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন যেভাবে এই ভাইরাসের মোকাবিলা করছে, উত্তর কোরিয়ার পক্ষে তা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ায় এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সব রকম সাহায্য করবে তারা। প্রয়োজনে প্রত্যাহার করা হবে একাধিক নিষেধাজ্ঞা।
ভিয়েতনামেও করোনা আতঙ্ক প্রবলভাবে ছড়িয়েছে। রাজধানী হ্যানয়ের উত্তরে একটি এলাকাকে গত ২০ দিন কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার মানুষ বসবাস করেন সেখানে। ভিয়েতনামের প্রশাসন জানিয়েছে, ওই অঞ্চলে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কা আছে বলেই এলাকাটিকে আলাদা করে রাখা হয়েছে, যাতে ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটে।
ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ ফেব্রুয়ারিতে চীনে সব ধরনের বিমান চলাচল স্থগিত করেছে।
করোনাভাইরাসের কারণে চীনের প্রতিবেশী সিঙ্গাপুরে আর্থিক মন্দা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং। গতকাল তিনি জানান, ইতোমধ্যে দেশটির অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব সার্সকে ছাড়িয়ে গেছে। চীনের পর সিঙ্গাপুরেই সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে।
এদিকে জাপানের ইয়োকোহামা বন্দরের কাছে পৃথক করে রাখা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের আরও ৪৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ২৯ জনই জাপানি নাগরিক।
প্রমোদতরীটিসহ জাপানে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪৭-এ পৌঁছাল।
করোনভাইরাসের কারণে এশিয়া সফর বাতিল করার পরিকল্পনা করছে প্রমোদতরী শিল্প। এতে এ খাতের আয়ে প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে সারাবিশ্বে বিমান পরিবহন ব্যবসায়ের আয় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৪০০-৫০০ কোটি ডলার কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা।
হুবেই প্রদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে এ রোগটাকে বেশ উপেক্ষা করা হয়। ফলে অনেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ছাড়াই মারা যান। অনেকে চোখের সামনে দেখেছেন স্বজনের নির্মম মৃত্যু। স্বজন হারানো এক চীনা নাগরিক বিবিসিকে জানিয়েছেন তার সেই মর্মন্তুদ কাহিনি।
জিয়াও হুয়াং নামের ওই তরুণ জানান, তার বাবার মৃত্যুর পর তাকে মানুষ করেন তার দাদা-দাদি। তাদের বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। হুয়াংয়ের বড় চাওয়া ছিল তার দাদা-দাদির জীবনের শেষ দিনগুলো যেন আনন্দে কাটে। কিন্তু তা আর হয় নি। করোনায় অসহায়ভাবে মারা গেছেন তার দাদা। আর তার দাদির অবস্থাও সংকটাপন্ন।
২০ জানুয়ারি তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ২৩ জানুয়ারি উহানে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় ২৬ জানুয়ারি তাদের হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়। ২৯ জানুয়ারি তাদের করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। এর তিন দিন পর তাদের ভর্তি করা হলেও কোনও বেড ছিল না। ছিল না চিকিৎসাকর্মীও। হুয়াং লিখেছেন, হাসপাতালটি ছিল গোরস্তানের মতো। বহু অনুনয়-বিনয় করেও তাদের জন্য বেডের ব্যবস্থা করতে পারেন নি হুয়াং। অবশেষে মৃত্যুর মাত্র তিন ঘণ্টা আগে তাকে বেড দেওয়া হয়।
চীনের টুইটার খ্যাত ওয়েবোতে হুয়াং লিখেছেন, ‘দাদা, দয়া করে শান্তিতে ঘুমাও। স্বর্গে কোনো কষ্ট নেই।’
তিনি লিখেছেন, অনেক রোগী মারা যাওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের শেষ দেখাটাও পাচ্ছেন না। হাসপাতালে কার্যকর কোনও ওষুধও নেই। ডাক্তাররা তাকে বলেছেন, আশাহত হয়ো না। ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দাও।
দুর্ভাগ্যজনক খবর হচ্ছে, হুয়াং নিজেও এখন অসুস্থ। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তাকেও কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।