সাত মার্চের ভাষণ
মুবিন খান
বিষয়টা আগেও বলা হয়েছে। আজ আরেকবার বলি। আজকে বলার মতন উপলক্ষ্য তৈরি আছে।
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ ছিলেন। আসলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ছিলেন বললে সঠিক করে বলা হয়। কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, অনানুষ্ঠানিকভাবে।
শেখ মুজিব আমাদের কাছে বিখ্যাত ছিলেন সাত মার্চের ভাষণের জন্যে। আমরা বড় বড় চোখ করে রাষ্ট্ররে লোকটার দেওয়া হুমকি শুনতাম। বিরাট শক্তিশালী রাষ্ট্ররনায়েকরে সকলকিছু অচল করে দেওয়ার হুমকি কেউ দিতে পারে সেটা আমাদের স্বৈরশাসনের অধীনে থাকা মন ভাবতে পারত না। তো এই লোকটার গলার উত্তেজনা শুনতে শুনতে তার জোশ আমাদের ভেতরেও প্রশমিত হতো। আমাদের রক্তেও নাচন লাগত। আমরা অস্থির হয়ে উঠতাম।
অস্থির হয়ে ওঠা আমাদের এই অস্থিরতা আমাদেরকে রাষ্ট্রর পরিচালকদের জন্যে, তাদের স্তাবকদের জন্যে আমাদের ভেতরে ক্ষোভ বানিয়ে দিত। এই ক্ষোভ দুর্বল আমাদেরকে সবল ভাবতে ভাবাইত। আমরা রাষ্ট্রর শীর্ষজনদের, তাদের স্তাবকদের ঘৃণা করতে থাকতে থাকতাম। করুণা করতে থাকতে থাকতাম। ন্যায় অন্যায় বোধে জাগ্রত হতে থাকতে থাকতাম।
শেখ মুজিবুর রহমানরে নিষিদ্ধ হওয়ার নিষেধাজ্ঞাটা একশ্রেণীর যুবক সেই বয়সে মানতে চাইত না। মানতও না। এরা বেয়াদব যুবক হিসাবে স্বীকৃত ছিল। গলির মোড়ে আড্ডায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে, চায়ের দোকানে টেবিল থাপড়াতে থাপড়াতে কিংবা রাজপথে গলার রগ ফুলিয়ে ফুলিয়ে এরা রাষ্ট্রর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করত। এই বেয়াদব যুবকদেরকে আমাদের ভালো লাগত।
কিন্তু ভালো লাগলেও তাদের সঙ্গে আমাদের বনিবনা হয় নি। আমরা আলাদা হয়ে রাষ্ট্রর পরিচালককে, তার স্তাবকদেরকে গালাগালি করতে থাকতে থাকলাম। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকতে থাকলাম। আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটাকে কালা শকুনে খামচি মেরে ধরেছে বুঝে ফেলতে পেরে কালা শকুনের খামচি মেরে থাকা নখ আলগা করতে, বনিবনা না হওয়া যুবকদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় গাড়িদের চাকা ফুটা করে দিতে থাকতে থাকলাম। আমাদেরকে তখন পুলিশে, আর্মিতে উচিত শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়ে হাড্ডি গুঁড়া করে দিয়ে ‘ল্যাংড়া লুলা’ বানিয়ে দিতে চাইত।
সাত মার্চের ভাষণ কিন্তু তার আবেগ দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়েই রাখল। তো ভাষণটা বাসার টুইনওয়ানে বাজিয়ে শুনব বলে একদিন খুঁজতে বের হলাম। হায়! নাই নাই নাই, কোত্থাও সাত মার্চের ভাষণ নাই। সেই সময়ের জাঁদরেল অডিওঅলাদের কাছেও পাওয়া গেল না। এলিফেন্ট রোডে গীতালীর পারভেজ তার পরিচিত আরেক অডিও দোকানের খোঁজ দিল।
নিউ মার্কেটের সেই দোকানদার বলল, তার কাছে এলপি থেকে করা একটা কপি আছে। কিন্তু সে আমারে তার কপিটা দেবে না, আমি চাইলে আরেকটা ক্যাসেটে কপি করে দেবে। তবে শর্ত হলো, সে যে আমারে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ সাত মার্চের ভাষণের কপিটা দিয়েছে, সে কথা আমি কাউরে বলতে পারব না। গোপন রাখতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের সাত মার্চের ভাষণ ছড়িয়ে দিতেছে জানলে তাকে পুলিশে ধরে ফেলবে। ধরে ফেলে তার ‘পুঞ্জিবাট্টা’ খেয়ে জেলে ভরে থুবে। অত্যন্ত যৌক্তিক শর্ত। এই ধরনের ঘটনাবলী তখন অহরহই ঘটছে। ওই লোককে তিরিশ টাকার ক্যাসেটের জন্যে ষাট টাকা দিয়ে, কাউকে বলব না বলে কিরা কসম কেটে সেদিন সাত মার্চের ভাষণ জোগার করতে হয়েছিল।
বাসায় এসে যখন ক্যাসেটটা টুইনওয়ানে ভরে প্লে করে দিতেই, শেখ মুজিব তাঁর উদাত্ত কন্ঠে ‘ভায়েরা আমার’ বলে উঠতেই রান্না করতে থাকা আম্মা ছুটে এসেছিলেন। ভাষণটা শুনতে শুনতে আম্মার চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। আমাদের রক্তর গতিবেগ দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। লাগোয়া বাসার বাবু, বাদল, রতন ছুটে এসে জান্লার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়েছিল।
তারপর কেউ একজন এসে বলেছিল, ‘ওই! সাউন্ড কমা! মোড়ের পুলিশে শুনলে আইসা ধইরা নিয়া যাবে।’
তারপরে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে বৈধ করতে, তাঁর নাম ফিসফিসিয়ে নয়, স্বাভাবিক কন্ঠে উচ্চারণ করতে, সাত মার্চের ভাষণ হাই ভল্যুমে বাজাতে আমাদের অনেককে পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ‘মাইর ধইর’ করেছিল। ‘ল্যাংড়া লুলা’ করে দিয়েছিল। অনেককে মেরেও ফেলেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশটাকে আমাদের কিশোরকালের মতো এখন আর কালা শকুনরূপী স্বৈরাচারী খামচি মেরে ধরে নেই। সাত মার্চের ভাষণ জোরে বাজাতে এখন আর ভয় নেই। লোকে বাজায়ও। একবার আগস্ট মাসে দেশে গিয়ে পনের আগস্টে সারাটা রাত ঘুমাতে পারি নি। বাসার পাশেই রাস্তার জায়গায় বেড়া দিয়ে ক্যাম্প বানিয়ে মাইক লাগিয়ে রাতভর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত মার্চের ভাষণ বাজাচ্ছিল। আমার মতো অনেকেই ঘুমায় নি। ঘুমাতে পারে নি। তারা বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করেন নাই। ‘ডরে’ করেন নাই। বেয়াদব ছেলেরা হাতে পায়ে বড় হলে শাসন না করে ডরানোর নিয়ম আছে।
আমার ছোটবেলাকার বেয়াদব যুবকদের সঙ্গে এখনকার বেয়াদব ছেলেদের মিল কোনও নেই। আমার দেখা যুবকেরা শেখ মুজিবকে জানতেন, রাষ্ট্রর নীতিদের জানতেন, খালি অন্যায় নয়, ন্যায়কেও জানতেন, সাত মার্চ ভাষণ ভালোবেসে শুনতেন। মানুষকে জোর করে শুনিয়ে নিজেরা বধির হয়ে থাকতেন না।
গেলবার শুনি লোকে ফিসফিসিয়ে বলছে, শেখ মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ ছিলেন যেই সময়টাতে, সেই সময়টাই নাকি দেশ ভালো ছিল, রাষ্ট্র ভালো ছিল!
আমরা কী প্রজন্মর পর প্রজন্ম কেবল ভুল করতেই থাকব! আমরা কী প্রজন্মর পর প্রজন্ম কেবল প্রশ্ন করতেই থাকব, ‘রাষ্ট্র, তুমি কার?’ ♦