‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্তে উদ্বেগ আওয়ামী লীগেও
চলমান বিদ্যুৎ সংকট এবং হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়া সরকার ও আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলে দিয়েছে স্বীকার করছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাথায় রাখতে হচ্ছে বলে এ সংকট আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকের ভেতরে ক্ষোভও জন্ম নিয়েছে।
দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত বলেও অভিহিত করেছেন। দলের নীতিনির্ধারকরা জানান, বাধ্য হয়েই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে।
দলের সভাপতি ও সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক নেতা ক্ষোভের কথা জানিয়ে বলেন, সরকারের অনেক কর্তার অদক্ষতাও এ সংকটের জন্য কিছুটা দায়ী।
প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সম্পাদকমণ্ডলীর অন্তত চার নেতা বলেন, ‘সরকারের নীতিনির্ধারণীতে নেই, আমাদের সঙ্গে বোঝাপড়াও নেই। হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয় দলের নেতাদের। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো কিছুতে না থেকেও জনগণের গালমন্দ খেতে হচ্ছে দলের নেতাদের।’ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘প্রতিক্রিয়াও দেব না, গালমন্দও খেতে পারব না।’ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, ‘মূলত তিন কারণে আমাদের দেশে সংকট দেখা দিয়েছে।
করোনা-মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বাংলাদেশি মুদ্রার মান কমে যাওয়া।’ তারা জানান, ‘প্রথম দুটি কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের কিছু অদক্ষ কর্মকর্তা ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর গাফিলতি। তাদের ব্যর্থতার দায়ভার একা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিতে হচ্ছে।’
গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় নাম প্রকাশ না করার শর্র্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা ফোনে আরও বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে মানুষের কাছে যেতে হবে। চলমান এ সংকট অব্যাহত থাকলে মানুষের কাছে অবমূল্যায়ন পেতে হবে। দেশের মানুষকে এ সংকটের ভেতরে রেখে শুধু উন্নয়ন নিয়ে ভোট চাইতে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মিথ্যাচার ও অপপ্রচার তো রয়েছেই। জাতীয় নির্বাচন মাথায় রেখে এ সংকট থেকে দেশের মানুষকে দ্রুত বের করে আনতে হবে। ‘কুইক’ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে সরকার অন্য যেসব খাতে ভর্তুকি দেয় বা দিচ্ছে, সেই খাতগুলোতে আপাতত ভর্তুকি কমিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট দূর করতে হবে।
সরকারি দলের এসব নেতা আরও বলেন, এই সংকট যে বৈশি^ক সে ব্যাপারে দেশের নামীদামি অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার করার উদ্যোগ নিতে হবে। দ্রুত সমাধানের জন্য সরকার অর্থনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের পরিকল্পনা ও পরামর্শ নিয়ে সংকট উত্তরণের সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গতকাল রাতে বলেন, দেশের অর্থনীতি যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য অনেকটা নিরুপায় হয়ে ডিজেল-অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে দরিদ্র, অতিদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের সাময়িক কষ্ট হবে। দ্রুত সংকট সমাধানের জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘আমদানি করা সব পণ্যের ক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প কিছু করা যায় কি না, তা-ও ভাবতে হবে। ডলার সাশ্রয়ে বিলাসী পণ্য আমাদানিতে “জিরো টলারেন্স” নীতি অনুসরণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার, এসি ও রেফ্রিজারেটর প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করাই ভালো হবে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে আজকের কঠিন বিশ্ব বাস্তবতায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর মতো একটি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে হলো। “সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল” এ জঘন্য নীতিতে বিশ্বাস করে না দেশপ্রেমিক আওয়াামী লীগ সরকার। ভোটের আগের বছর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি দলের জন্য আত্মহত্যার শামিল জেনেও দেশ বাঁচানোর বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় করতে হলো। অন্যথায় ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা আসত, তা সামাল দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।’
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘চলমান বিদ্যুৎ সংকট, হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে চাপে ফেলেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আওয়ামী লীগও চাপে পড়েছে। এ ইস্যু সামনের নির্বাচন ঘিরে আরও চাপে ফেলবে কোনো সন্দেহ নেই। দ্রুত এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলবে। তবে এ সংকট শুধু আমাদের দেশের নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের। এ বাস্তবতাও নিশ্চয় দেশের মানুষ বুঝবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাড়িয়ে দ্রুত পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে সামনে জাতীয় নির্বাচন। আমাদের বিরোধী মত ও পথের রাজনৈতিক দলগুলো মিথ্যাচার করে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে। জনগণকে বুঝতে হবে বিশ্ব বাস্তবতা।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ব বাস্তবতায় এ সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশও। সম্মিলিভাবে এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে।’