অর্থনৈতিক চাপে ৯০ শতাংশ পরিবারে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন
গ্রাম বা শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও গত ছয় মাসের ব্যবধানে তাদের ব্যয় ও খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ছয় মাসে নিম্ন আয়ের পরিবারের খরচ ১৩-১৪ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে নিম্ন আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে।
পরিবর্তনগুলো হচ্ছে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ, মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ, ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ, তেল খাওয়া কমিয়েছে ৮১ শতাংশ, চাল খাওয়া কমিয়েছে ৩৭ শতাংশ এবং আটা খাওয়া কমিয়েছে ৫৭ শতাংশ। নিম্ন আয়ের অনেক পরিবার মাঝেমধ্যে এক বেলা কম খেয়ে থাকছে। অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারকে সঞ্চয় ভেঙে ও ঋণ করে চলতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) দেশের আট বিভাগেই এক খানা জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পেয়েছে। গত ৯ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে শহর ও গ্রামের নিম্ন আয়ের এক হাজার ৬০০ খানার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ? সানেমের জরিপের ফলাফল’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। অনুষ্ঠানে সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশাসহ অন্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
সেলিম রায়হান বলেন, জরিপে নিম্ন আয়ের এসব মানুষের কাছে ব্যয় বাড়ার বিষয়টি কিভাবে মোকাবেলা করছেন—এমন প্রশ্ন রাখা হয়। জবাবে ৯০ শতাংশ পরিবার বলেছে, তারা তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে। ধার বা ঋণ করে চলছে ৭৪ শতাংশ পরিবার। খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমিয়েছে ৫৬ শতাংশ পরিবার। আগের চেয়ে বেশি কাজ করছে ৪০ শতাংশ পরিবার। অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভর করছে ৩৫ শতাংশ পরিবার। আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে ৩৫ শতাংশ পরিবার। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচও কমিয়েছে ১০ শতাংশ পরিবার।
সেলিম রায়হান বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের সুযোগ এমনিতেই কম। তার ওপর তাদের এ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় শহর ও গ্রামের মধ্যে খাদ্য পরিবর্তন করেছে ৯৪ শতাংশ পরিবার। গ্রামে সেটা ৮৬ শতাংশ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ধার করে চলছে শহরের ৭৪ শতাংশ এবং গ্রামের ৭৪ শতাংশ পরিবার। গত ছয় মাসের ব্যবধানে ফুড (খাদ্য) ও নন-ফুডের (খাদ্যবহির্ভূত) ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খরচ বেড়েছে খাদ্যে। শহরে খাদ্যে ব্যয় বেড়েছে ১৯ শতাংশ, গ্রামে ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ।
জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ছয় মাসের ব্যবধানে গ্রামের তুলনায় শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যগ্রহণ বেশি কমিয়েছে। শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ ৪১ শতাংশ চাল খাওয়া কমিয়েছে, গ্রামে কমিয়েছে ৩২ শতাংশ। শহরে আটা খাওয়া কমিয়েছে ৬৫ শতাংশ, গ্রামে কমিয়েছে ৪৭ শতাংশ। শহরে ডাল খাওয়া কমিয়েছে ৪৭ শতাংশ, গ্রামে কমিয়েছে ৪৩ শতাংশ। মাংস খাওয়া শহরে কমিয়েছে ৯৭ শতাংশ, গ্রামে কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ। শহরে মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৯০ শতাংশ, গ্রামে কমিয়েছে ৮৭ শতাংশ। শহরে পরিবারগুলো ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৮ শতাংশ, গ্রামে কমিয়েছে ৭৬ শতাংশ। তবে তেল খাওয়ার ক্ষেত্রে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ কমিয়েছে ৮১ শতাংশ, গ্রামের মানুষ কমিয়েছে ৮২ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বৈশ্বিক ও জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই চ্যালেঞ্জ আরো বেশি।
গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, তাঁদের এই জরিপে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে রিকশাচালক, দিনমজুর, কৃষক, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছেন। গত ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব এবং কিভাবে তারা মোকাবেলা করেছে, সেটা বোঝার জন্যই এই জরিপ চালানো হয়। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ ভালো মানের চাল ছেড়ে নিম্ন মানের চাল খাচ্ছে।