আড্ডা, আলাপে আর আনন্দে বাংলা চ্যানেলের নৈশভোজ
‘বাংলাদেশে আমি রেডিওলজি নিয়ে কাজ করতে চাই। কাজ করতে এসে আমি দেখলাম এই সমস্যাটা নিয়ে এর আগে সেভাবে কেউ কাজ করে নি। আমি দিনাজপুরসহ এদেশের বেশ কয়েক জায়গার সরকারি
হাসপাতালগুলোতে গিয়েছি। যাওয়ার পর সেখানে দেখেছি, অনেক হাসপাতালেই, যেমন ধরুন সিটি স্ক্যান, এক্সরে, এমআরআই, আলট্রাসনোগ্রাম, রেডিওগ্রাফি ,মেমোগ্রাফি ইত্যাদি যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা হয় না। আবার দেখা গেছে, অনেক হাসপাতালে যে যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত দামি হলেও সেসব পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে জনবল নেই। বেশকিছু হাসপাতালে এমনও দেখা গেছে যে, রেডিওলজির এসব যন্ত্রপাতি কিনে এনে সেই যে ফেলে রাখা হয়েছে, বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও প্যাকিংই খোলা হয় নি! আপনিই বলুন, যন্ত্র যদি চালানোই না হয়, তাহলে শুধু শুধু দেশের টাকা খরচ করে এসব কেনা হলো কেন!’
কথাগুলো মোহাম্মদ মেরাজুল হক সোহাগ বলছিলেন রূপসী বাংলার নির্বাহী সম্পাদক মুবিন খানকে। মোহাম্মদ মেরাজুল হক সোহাগ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস থেকে এসেছেন। সেখানে তিনি ডেজার্ট ভ্যাসকুলার ইন্সটিটিউটের ভ্যাসকুলার ও ইন্টারভ্যাসনাল রেডিওলজিস্ট। মেরাজুল হকের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা আমেরিকাতেই। এখন পেশাগত কারণে থাকেন লাস ভেগাসে। সেখানে ডেজার্ট ভ্যাসকুলার ইন্সটিটিউটে কর্মরত আছেন। ভদ্রলোক বাংলা তেমন ভালো জানেন না। অল্প অল্প বলতে পারেন। কিন্তু লিখতে-পড়তে পারেন না। এতক্ষণ ধরে বলা কথাগুলো নব্বই ভাগ ইংরেজির সঙ্গে দশ ভাগ বাংলা মিশিয়ে বলছিলেন।
কিন্তু সকল প্রকার সুবিধা আর প্রাচুর্যময় জীবন নিয়েও সন্তুষ্ট নন মেরাজুল হক। বাংলাদেশ তার কাছে রূপকথার মতো। তিনি সে রূপকথাকে বাস্তবতায় ছুঁতে চান। নিজের পেশাগত দক্ষতা দিয়ে কাজ করতে চান বাংলাদেশের জন্যে। তাই নাড়ীর টানেই ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। এসে খুব অল্পদিনেই উপলব্ধি করে ফেলেছেন ভ্যাসকুলার ও ইন্টারভ্যাসনাল রেডিওলজি সংক্রান্ত প্রযুক্তি বিজ্ঞান নিয়ে এদেশে আশানুরূপ কাজ করা হয় নি।
এ আলোচনাটা যেখানে চলছিল, সেটা এমন আলোচনার জায়গা নয়। সে পরিবেশও নয়। কথা চলছিল রাজধানীর গুলশানের প্রান্তে বনানীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিলাস বহুল ‘আমারই ঢাকা’ হোটেলে। সেখানে গেল ১০ জানুয়ারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলা চ্যানেল’ আয়োজন করেছিল এক প্রীতি নৈশভোজের। বাংলা চ্যানেল-বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান নির্বাহী এম. ইকবাল বাহার রূপসী বাংলার নির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে মেরাজুল হকের আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দিয়েই সরে পড়েছেন। ভদ্রলোক প্রচণ্ড ব্যস্ত। ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু ফুরসৎ পেলেই অবশ্য ছুটে এসে খুব উৎসাহে আলোচনার অংশ হয়ে উঠছেন। আমরা আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে জনাব ইকবাল বাহারের প্রকৃত হোস্ট হয়ে ওঠার প্রবল প্রচেষ্টা দেখছিলাম।
আসলে তখনও অন্য অতিথিরা পৌঁছেন নি বলেই আমরা ও আলোচনার সুযোগটা নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু আলোচনা বেশিদূর গড়াতে পারে নি আর। কেননা ততক্ষণে ইঞ্জিনিয়ার হারুনর রশিদকে সঙ্গী করে ড. শাহজাহান মাহমুদ এসে পড়েছেন। ইঞ্জিনিয়ার হারুনর রশিদ নিউ ইয়র্কের আইটি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্কোপেইন টেকনোলজি সলিউশন্সের এমডি। ড. শাহজাহান মাহমুদ প্রায় তিন বছর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সফলভাবে পালনের পর মেয়াদ শেষে সরকার তাকে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন্স স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএসসিএল) বোর্ড চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন গেল বছরে। অর্পিত সে দায়িত্ব তিনি বেশ সফলভাবেই পালন করে চলেছেন।
বছরে ১২৫ কোটি টাকারও বেশি আয় করা কোম্পানিটির অন্যতম প্রধানের দায়িত্বে থাকা মানুষটি যতটা ভারিক্কী আর দূরের মানুষ মনে করা হয়েছিল, দেখা গেল তিনি মোটেই তা নন। বরং বেশ হাস্যোজ্জ্বল, মিশুক এবং বন্ধুবৎসল। বাংলা চ্যানেলের বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ এম. ইকবাল বাহার বিসিএসসিএল চেয়ারম্যানের সঙ্গে সকলের আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্বর পর খুব অল্পসময়েই ভদ্রলোক আড্ডা আলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠলেন।
আড্ডা আলাপ শুরুর ঠিক প্রাক্কালেই চলে এলেন লালমনিরহাট-১ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মো. মোতাহার হোসেন। ভদ্রলোকের কথাবার্তা আর আচরণে মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই যে তিনি পরপর চার মেয়াদে টানা উনিশ বছর ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। সেই ২০০১ সাল থেকে আজ অবধি। এবং গেল বারে ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।
চলনে বলনে তাঁকে রাজনীতিকের চেয়ে বেশী শিক্ষক মনে হয়। হ্যাঁ, প্রথম জীবনে পেশাগত দায়িত্বে তিনি একজন স্কুল শিক্ষকই ছিলেন। সেটা সত্তর দশকেরও আগে। ১৯৭১-এ যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, তখন এই স্কুল শিক্ষকই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে। এই ভদ্রলোক এক সময়ের স্কুল শিক্ষক, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট, দু বার নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, বিরোধীদলীয় হুইপ, জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি এবং মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবং উনিশ বছর ধরে সংসদ সদস্য- বিশাল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানুষ মো. মোতাহার হোসেন।
আড্ডা আলাপে ক্ষণকালেই বিসিএসসিএল চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদের ঠিক পাশের জায়গাটি খুব অবধারিতভাবেই যেন নিয়ে নিলেন সংসদ সদস্য মো. মোতাহার হোসেন। আলাপের নিয়ন্ত্রণও চলে গেল এ দুজনেরই হাতে। রূপসী বাংলার নির্বাহী সম্পাদক মুবিন খান কথা বলে বলে এঁদের কাছ থেকে অনেক অনেক কথা নেবেন এমন একটা পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার সে পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখল না। অবশ্য মুবিন খান যে খুব হতাশ হয়েছেন, তাও নয়। অতিথিদের আলোচনায় দেশের চলমান রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি হয়ে পররাষ্ট্রনীতি, রোহিঙ্গা সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের তালিকা, বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বিষয়গুলোতে যখন হাঁটাচলা করছিল, মুবিন খানকে তখন বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আলোচনায় অংশ নিতে দেখা গেছে। তার কাছে সবই খুব লোভনীয় বিষয়।
বাংলা চ্যানেলের বাংলাদেশ প্রধান এম. ইকবাল বাহার তখনও ছুটে চলেছেন এখানে-ওখানে-সেখানে। আগের মতোই ফাঁকে ফাঁকে এসে যুক্ত হতে না হতেই আবারও ছুটছেন। অবশেষে ড. শাহজাহান মাহমুদ তাকে ডেকে এনে একটা চেয়ারে আটকে ফেললেন। এসময় বেশ কৌতুক চলেছিল। চলেছিল সহাস্যরস। আড্ডা আলাপ হয়ে উঠেছিল আরও আরও প্রাণবন্ত।
তুমুল এই আড্ডাতেও বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের এইচআর শামীমা আক্তার কেমন করে যেন ভাবলেশহীন হয়ে উঠেছিলেন। মূল আড্ডা ছেড়ে তিনি পাশের টেবিলে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিজয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদা নার্গিস হকের সঙ্গেই একান্তে মশগুল ছিলেন। যেন দুজনে আলাদা জগত খুলে বসেছেন। যেন দুজনে আর কাউকে তাদের সে জগতে প্রবেশাধিকার দেবেন না। তবুও, দেখা গেল, এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্কের সহকারি সহকারি মেহেদী হাসান একটু পর পরই ঘুরে আসছিলেন সে জগত থেকে। আর যাচ্ছিলেন তড়িৎ গতিতে ছুটতে থাকা ইকবাল বাহার।
এভাবে চলতে চলতে কখন যে সময়ের কাঁটা রাত বারোটার নির্দিষ্ট জায়গাটা অতিক্রম করে আরও অনেকটা এগিয়ে গেছে, সেটা কেউই বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারার পর সকলের মাঝে একটা তড়িঘড়ি শুরু হয়ে গেল। আর তখনই ইকবাল বাহার স্বরূপে আবির্ভূত হলেন। পুরোপুরি বাংলা চ্যানেলের বাংলাদেশ প্রধান হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, ফোটোসেশন করতে হবে। প্রধান যিনি, তার কথা তো শুনতেই হয়। সে কথা ড. শাহজাহান মাহমুদ আর সংসদ সদস্য মো. মোতাহার হোসেনের কাছে অনুরোধ হলেও বাকিদের কাছে আদেশই ছিল।
ফোটোসেশন চলতে থাকার ফাঁকে ড. শাহজাহান মাহমুদ আজকের নৈশভোজের আয়োজনকে উৎসাহিত করলেন। বললেন, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কিংবা পয়লা বৈশাখের মতো দিনগুলোতে- মানে বাংলাদেশের বিশেষ আর স্মরণীয় দিনগুলোতে এ ধরনের আয়োজন করা উচিত।
যদিও সংসদ সদস্য মো. মোতাহার হোসেন সে আয়োজনে নিজে উপস্থিত থাকতে না পারার কথা বলে আগেই অপারগতা জানিয়ে রাখলেন। কেননা সেসব দিনে তাকে রাষ্ট্রীয় অথবা এলাকার আয়োজনে থাকতে হয়।
এভাবে আলাপে আলাপে সাঙ্গ হলো ছবি তোলা। ছবি তোলা শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়। এরপর বিদায়ের পালা। না, বিদায় মানে বিষাদ নয়। অমন প্রাণবন্ত আর স্বতঃস্ফূর্ত একটা আয়োজনে বিষাদ থাকতে নেই। বিষাদের জায়গা নেই ওখানে। আছে প্রতীক্ষা। আবারও মিলবার। আরও আরও প্রাণবন্ত আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আরও বড় পরিসরে। বাংলা চ্যানেলের আরও স্বজনদের নিয়ে।
বাংলা চ্যানেল নৈশভোজে যারা অতিথি হয়েছিলেন:
মো. মোতাহার হোসেন
মাননীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
ড. শাহজাহান মাহমুদ
বিসিএসএসসিএল চেয়ারম্যান।
মোহাম্মদ মেরাজুল হক সোহাগ
ভ্যাসকুলার অ্যান্ড ইন্টারভ্যাসনাল রেডিওলজিস্ট, ডেজার্ট ভ্যাসকুলার ইন্সটিটিউট, লাস ভেগাস, যুক্তরাষ্ট্র।
মাহমুদা নার্গিস হক
ভাইস প্রেসিডেন্ট, সাপ্তাহিক বিজয়, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
ইঞ্জিনিয়ার হারুনর রশিদ
এমডি, স্কোপেইন টেকনোলজি সলিউশন্স, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
এম. ইকবাল বাহার
বাংলা চ্যানেল-বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান নির্বাহী
মুবিন খান
নির্বাহী সম্পাদক, রূপসী বাংলা।
শামীমা আক্তার
এইচআর, রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্ক।
মেহেদী হাসান
সহকারি, রূপসী বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্ক।
আবু বকর সিদ্দিক শ্যামল এবং আরও অনেকে।