চলে গেলেন একজন অসামান্য স্বশিক্ষিত কৃষি বিজ্ঞানী কেনু মিস্ত্রী
মো. আব্দুল্লাহ আল পাঠান। একজন কাঠমিস্ত্রি। কেনু মিস্ত্রী নামে তিনি সমাধিক পরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতিরেকে তিনি হয়ে উঠেছেন কৃষকবান্ধব যন্ত্রপাতির উদ্ভাবক। বিশেষ করে দরিদ্র কৃকষকদের জন্য তিনি ছিলেন আশির্বাদ স্বরূপ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে স্থান পেয়েছে তার তৈরি যন্ত্রপাতি। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেন।
প্রায় ৪০ বছর আগের কথা, তখন ইরি ধানের মৌসুম। গ্রামের সব কৃষক খেতের আগাছা পরিষ্কার করতে দিশেহারা। সারাদিন কাজ করে ৫ জন মজুর মাত্র ৮ শতাংশ জমির আগাছা পরিষ্কার করতে পারছেন। কৃষকদের এই নাজেহাল অবস্থা কেনু মিস্ত্রিকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি চিন্তা করতে থাকলেন কিভাবে কৃষকদের পরিশ্রম লাঘব করা যায়। তার এই ভাবনার ফসল কাঠের হাতওয়ালা লোহার পাতের নিড়ানি যন্ত্র। নাম দিলেন সেমি উইডার। এই নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে একজন মজুর একদিনে ১২ শতাংশ জমির আগাছা পরিষ্কার করতে সক্ষম হলো। ইরি ধান চাষীদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল এই নিড়ানি যন্ত্রের খবর।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বানিয়েছেন ৪০টির বেশি হস্তচালিত কৃষি যন্ত্র। মাটি খননের আগর যন্ত্র। উঁচু গাছে কীটনাশক প্রয়োগ যন্ত্র। বিভিন্ন ফসলের বীজ বপনে উপযোগী ভিন্ন ভিন্ন বীজ বপন যন্ত্র। গুটি সার প্রয়োগ যন্ত্র। উদ্ভাবন করেছেন আঁচড় যন্ত্র ও চার ধরনের নিড়ানি যন্ত্র। আরও তৈরি করেছেন সহজে জমিতে সেচ দেয়ার পাড়াকল, সোন ও জাতকান্দা। তৈরি করেছেন আধুনিক কোদাল, খন্তা ও গভীর কাদা থেকে সহজে মাছ শিকার যস্ত্র ‘হওড়া’।
তার উদ্ভাবিত অন্যান্য কৃষি যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে আধুনিক ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র, ফসলের মাটি ঝুরঝুরা করার যন্ত্র, সহজে মাটি খননের আগরযন্ত্র, গোল আলুর বীজবপন যন্ত্র, নির্দিষ্ট দূরত্বে শস্যবীজ বপনযন্ত্র, সবজি বীজ বপনযন্ত্র, সবজি গাছের ডগা কেটে ফেলার কাটারযন্ত্র, ক্ষেত বা উঁচু গাছে কীটনাশক স্প্রে করার যন্ত্র, সবজির চারা উত্তোলন যন্ত্র, আধুনিক দা, আধুনিক খন্তা, আধুনিক কাঁচি, আধুনিক কোদাল, গুটি সার প্রয়োগ যন্ত্র, সহজে জমিতে সেচ দেওয়ার পাড়াকল, পানি সেচের ছাতকুন্দা, সেমাই বানানোর যন্ত্র ইত্যাদি ৪২টি সুলভ মূল্যের কৃষি যন্ত্র। এগুলো যন্ত্র তৈরিতে তিনি সহজলভ্য দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বাঁশ, কাঠ, ইস্পাত দন্ড, লোহা ও সাইকেলের চেইন ইত্যাদি। উল্লিখিত সকল উদ্ভাবন সামগিই্র রয়েছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে।
কৃষি যন্ত্রপাতি বানানোর পাশাপাশি তিনি তৈরি করছেন চমৎকার ও বিরল ধরনের সৌখিন সামগ্রী। এসব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। জাদুঘরের ৫ নম্বর কক্ষে তার তৈরিকৃত ‘কৃষকের বসতবাড়ি’ নামের শৈল্পিক সৃষ্টিকর্ম স্থান পেয়েছে। দু বছরের ফেলোশিপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে রেখে কৃষি ও অন্যান্য সামগ্রি বানিয়ে নেয়া হয়েছে। জাদুঘরের ৪টি কক্ষে রয়েছে তার কৃষি যন্ত্রপাতি। আর জাদুঘরের ভিন্ন একটি পরিসরে স্থান পেয়েছে কৃষকের বসতবাড়ি নামীয় তার অসাধারণ শিল্পকর্ম।
কেনু মিস্ত্রীর তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রের বিশেষ কোনও নাম নেই। সহজ-সরল মানুষটি কখনও প্যাটেন্ট করার কথাও ভাবেন নি। তবে এগুলো ব্যবহারে দেশের কৃষির উন্নতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি খাত। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছেন। তাদের মাধ্যমে অন্য জেলায়ও এগুলোর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে। এতেই তিনি তুষ্ট কেনু মিস্ত্রীর যন্ত্র বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করে আশাতীত শস্য উৎপাদনে সফল হয়েছেন অনেকে। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির নকলও হচ্ছে দেদারসে।
জীবদ্দশায় কেনু মিস্ত্রী স্থানীয় জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ এবং অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বেশকিছু সনদ ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ঢাকার জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন তাকে ঢাকায় এনে স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন মেলায় তাকে সম্মাননা ও পদক দিয়েছে। তার একমাত্র স্বপ্ন সম্পর্কে একদা জানিয়েছিলেন, ‘আমার উদ্ভাবিত স্বল্পমূল্যের কৃষি যন্ত্রগুলো আমি সারাদেশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই এটাই আমার একমাত্র স্বপ্ন। এজন্য গ্রামে একটি ওয়ার্কশপ ও সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অর্থাভাবে সেটা সম্ভব হয় নি। কেনু মিস্ত্রীর একমাত্র সন্তান কাইয়ুম পাঠান পিতার পথ অনুসরণ করে উদ্ভাবনের কাজ করার প্রয়াস পাচ্ছেন।
এখানে উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে সারাদেশে কেনু মিস্ত্রীর মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী কৃষি, সুলভ ও উন্নত প্রযুক্তি, শিক্ষা, প্রাকৃতিক ঔষধ, পরিবেশ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে বিস্ময়কর উদ্ভাবন সামগ্রী প্রস্তুত করছেন। এদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা গেলে সন্দেহাতীতভাবে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
আইয়ুব হোসেন: লেখক ও গবেষক এবং সম্পাদক, জনবিজ্ঞান