চীনের শিক্ষা রপ্তানি
দুবাইয়ের চীনা স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০০। তাদের বেশির ভাগই সেসব চীনা নাগরিকদের সন্তান, যাঁরা কাজের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। বিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস বেশ ছিমছাম। দেশে থাকলে এই শিক্ষার্থীরা যে পাঠ্যক্রম অনুসারে পড়াশোনা করত, দুবাইয়ের স্কুলে তারা মোটামুটি একই রকম পাঠ্যক্রম অনুসরণ করছে।
বিদ্যালয় ভবনের এক দেয়ালে ঝুলছে চীনা নেতা সি চিন পিংয়ের একটি উদ্ধৃতি—স্বর্ণালী অক্ষরে লেখা। ২০২০ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয়। তবে সেই থেকে এর কলেবর দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। বিশ্বের বিভিন্ন বড় শহরে আন্তর্জাতিক স্কুল খোলার যে কথা চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বলে আসছে, তারই অংশ।
ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে ব্রিটেন, আমেরিকাসহ বিশ্বের ৪৫টি দেশে চীনা কূটনীতিকদের বলা হয়েছিল এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরে আমেরিকান, ব্রিটিশ ও ফরাসি স্কুল আছে। কিন্তু চীনা পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাতে গোনা। যদিও এক কোটির বেশি চীনা নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করে বলে ধারণা করা হয়। চীনা স্কুল না থাকার কারণে অনেক নাগরিক বিদেশে দেশটির কোম্পানিগুলোতে কাজ করতে যেতে আগ্রহী হন না বলে সরকার মনে করছে।
যেসব চীনা শিশু বিদেশি শিক্ষাক্রম ব্যবহার করে লেখাপড়া করে, তারা দেশে ফিরে বেশ সমস্যায় পড়ে। তবে যেসব শিক্ষার্থী আবার পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান, তাঁদের জন্য বিদেশি শিক্ষাক্রম সাহায্য করে। পশ্চিমা ডিগ্রি থাকলেই বরং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া চীনাদের জন্য সুবিধাজনক।
তবে বুদ্ধিমান চীনা শিশুরা অবশ্য দেশে ফিরে সেরা কলেজগুলোয় ভর্তি হতে চেষ্টা চালায়। সে কারণে তাদের দরকার চীনা পাঠ্যক্রমের সনদ।
তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তায় অন্য যে বিষয়টি কাজ করে, তা হলো সফট পাওয়ার বা অনুচ্চ প্রভাব। কর্মকর্তারা সম্ভবত বিশ্বাস করেন যে শুধু চীনা প্রবাসী নয়; বরং স্থানীয় সমাজ থেকেও শিক্ষার্থী পাওয়া যেতে পারে। এটা খুব অচিন্তনীয় ব্যাপারও নয়।
ফ্রান্সের সরকার বিদেশে যেসব ফরাসি স্কুল চালায়, তার মাত্র ৪০ শতাংশ ফরাসি নাগরিকদের সন্তান। আমেরিকান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে, তার তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থীই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়।
২০২০ সালে চীনের সরকার জানায় যে তারা একটি ‘আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রম’ তৈরির চেষ্টা করছে, যা এমন সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রাসঙ্গিক হবে, যাদের চীনে বাস করার কোনো পরিকল্পনা নেই। সেটা হলে এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা চীনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাত্ত্বিকভাবে বর্তমানে প্রচলিত বৈশ্বিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা স্কুলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেঞ্চার এডুকেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুবাইয়ের স্কুলের মতো সরকারি সমর্থনপুষ্ট প্রকল্প আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ করার চীনা উদ্যোগগুলোর একটি। চীনের অনেক বেসরকারি স্কুল এখন বিদেশে বিনিয়োগ করছে, বিশেষ করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। এসব স্কুল এমন পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে, যার বিশাল চাহিদা রয়েছে। ভবিষ্যতে এসব স্কুল চীনা ভাষায় পাঠদান বা চীনা পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতে পারে, যদি পার্টি এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে।
চীনাদের এই কার্যক্রমের মানে হলো বর্তমানে বিভিন্ন দেশে চালু থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আরও বেশি প্রতিযোগিতা। ভেঞ্চার এডুকেশনের জুলিয়ান ফিশার বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই এখন চীনা শিক্ষার্থী পাচ্ছে। এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যায্য প্রতিযোগিতা করবে।
জুলিয়ান ফিশারের মতে, রাষ্ট্র–সমর্থিত স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করাতে হয়তো চীনাদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। আর যদি এমন ধারণা দেওয়া হয় যে চীনা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা দেশে ফিরে সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে, তাহলে এসব স্কুল আরও বেশি চীনা শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে পারবে।