জানুয়ারিতেই কলকাতায় আনোয়ারুলকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে কলকাতায় গাড়ির মধ্যে খুনের পরিকল্পনা হয়েছিল। ১৮ জানুয়ারি তাঁকে খুন করে কলকাতার বর্জ্যখালে ফেলে দেওয়ার চিন্তা ছিল খুনিদের। কিন্তু আনোয়ারুল সেদিন কলকাতায় না গিয়ে ১৯ জানুয়ারি যাওয়াতে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এ জন্য মে মাসে ব্যবসায়িক আলোচনার কথা বলে তাঁকে কলকাতায় ডেকে নিয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন।
কলকাতায় ১৩ মে খুন হন আনোয়ারুল আজীম। এ ঘটনায় দুই দেশে গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, ভ্রমণসংক্রান্ত রেকর্ড, ডিজিটাল প্রমাণাদিসহ তদন্তে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংসদ সদস্যকে হত্যার বিষয়ে একটা চিত্র পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্তসার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাতে বলা হয়, সংসদ সদস্যের আনোয়ারুলের বন্ধু আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন। দুজনেরই কলকাতায় সোনার ব্যবসা থাকার জনশ্রুতি আছে। তাঁরা যে ব্যবসা করতেন, সেগুলোর টাকাপয়সার লেনদেন নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভ ছিল।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই আনোয়ারুলকে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় (ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে) খুন করার পরিকল্পনা ছিল আক্তারুজ্জামান ও শিমুল ভূঁইয়াদের। এ জন্য আনোয়ারুল আজীমের ওপর নজরদারি করতে বাদল নামের এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন আক্তারুজ্জামান। কিন্তু সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যকে দেশের ভেতরে খুন করে পার পাওয়া যাবে না, এমন চিন্তা থেকে পরে ওই পরিকল্পনা থেকে সরে আসা হয়। পরে আনোয়ারুলকে কলকাতায় নিয়ে খুনের পরিকল্পনা করেন। আক্তারুজ্জামানের ধারণা ছিল, কলকাতায় খুন করলে সবাই ধরে নেবে সেখানকার ব্যবসায়িক সহযোগীরা আনোয়ারুলকে খুন করেছেন। এ জন্য ১৮ জানুয়ারি কলকাতায় গাড়ির ভেতর খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। তাঁদের ছক ছিল আক্তারুজ্জামান গাড়ি চালাবেন, আনোয়ারুল তাঁর পাশে সামনের আসনে বসবেন। গাড়ির পেছনে থাকবেন শিমুল ভূঁইয়া, সিয়াম হোসেন ও জিহাদ হাওলাদার। গাড়িতে খুনের পর লাশ বর্জ্যখালে ফেলে দেওয়া হবে।
কলকাতায় প্রথম দফায় ব্যর্থ হয়ে মে মাসে আবার খুনের পরিকল্পনা করা হয়। এর অংশ হিসেবে ২৫ এপ্রিল কলকাতার নিউটাউনে বাসা ভাড়া নেন আক্তারুজ্জামান। ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান, শিমুল ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান গিয়ে সেই ফ্ল্যাটে ওঠেন। আক্তারুজ্জামান ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে কলকাতায় ডেকে নেন। ১২ মে আনোয়ারুল কলকাতায় যান। শিমুল ভূঁইয়াকে দিয়ে খুনের ছক কষে আক্তারুজ্জামান ১০ মে কলকাতা থেকে চলে আসেন। যদিও আনোয়ারুল জানতেন আক্তারুজ্জামানও কলকাতার ওই ফ্ল্যাটেই আছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়ার বর্ণনা অনুযায়ী, ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে কিছু আলাপ–আলোচনা ও হালকা নাশতা করেন তাঁরা। কিন্তু কিছু একটা সন্দেহ করে আনোয়ারুল আজীম উঠে আসতে চান। তখন শিমুলের সহযোগীরা চেয়ারে চেপে ধরে বেঁধে ফেলেন। তাঁর ওপর চেতনানাশক প্রয়োগ করে বিবস্ত্র করে ছবি তোলেন। সেই ছবি আক্তারুজ্জামানকে পাঠান। ওই ছবি ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদের কাছেও পাঠানো হয়।
ঢাকা ও কলকাতা পুলিশের তদন্তে আরও এসেছে, ১২ মে কলকাতায় গিয়ে আনোয়ারুল কলকাতার মণ্ডলপাড়া লেনের তাঁর পুরোনো বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় উঠেছিলেন। সে বাসা থেকে পরদিন বেলা ১টা ৪০ মিনিটে বের হন ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে। এর ৩০ মিনিট আনোয়ারুল ফোন করে গোপাল বিশ্বাসকে ৪ লাখ ২০ হাজার রুপি পাঠাতে বলেন। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ওই সময় এত টাকা বহন করা ঝুঁকিপূর্ণ, এটা জানানোর পরও আনোয়ারুল জোরাজুরি করেন। গোপাল বিশ্বাস তাঁর ম্যানেজারকে দিয়ে ৪ লাখ ২০ হাজার রুপি পাঠান। বিধানপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে আনোয়ারুলকে সেটা দেওয়ার পর তিনি একটি সাদা গাড়িতে উঠে চলে যান। কিন্তু ওই ৪ লাখ ২০ হাজার রুপি পরে কোথায় গেল, সেটা এখনো জানা যায়নি।
এ বিষয়ে গোপাল বিশ্বাসের বক্তব্য জানতে তাঁর সে দেশের মুঠোফোন নম্বরে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। একপর্যায়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁকে কল করার কারণ জানতে চেয়ে বাংলাদেশি একটি ফোন নম্বর থেকে এক ব্যক্তি কল করে জানতে চান, কেন গোপালের নম্বরে কল দেওয়া হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর ফোন ধরেননি।
আনোয়ারুল হত্যার এক মাস পার হলেও এখনো লাশ উদ্ধার হয়নি। লাশ গুমে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সিয়াম হোসেনকে নিয়ে কলকাতা পুলিশ খাল থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে। এর আগে ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার করা হয়। এসব আনোয়ারুলের দেহাংশ কি না, সেটা ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা যাবে। এই ঘটনায় দুজন কলকাতায় ও বাংলাদেশে পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে শিমুল ভূঁইয়ার জবানবন্দি দেওয়ার পর পুলিশ ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতা কাজী কামাল আহম্মেদ ও সাইদুল করিমকে গ্রেপ্তার করে।
কাজী কামাল আহম্মেদ গতকাল শুক্রবার ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা কাজী কামাল আহমেদ রিমান্ডে আছেন আর আক্তারুজ্জামান বিদেশে পলাতক রয়েছেন বলে জানায় পুলিশ।
বিভ্রান্ত করতে ‘শ্রেণিশত্রু’ তত্ত্ব
মূল খুনি হিসেবে গ্রেপ্তার একসময়ের চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া ৫ মে ঢাকার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, তাঁর দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) ১৯৯৮ সালে আনোয়ারুলকে ‘শ্রেণিশত্রু’ আখ্যা দিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চোরাকারবার ও জোরপূর্বক মানুষের জমি দখলের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২৬ বছর পর তিনি সেটা বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁর দাবি, সংসদ সদস্যকে খুন করে ‘হজম’ করতে পারবেন না বিধায় তিনি আক্তারুজ্জামানের সহায়তা নিয়েছেন।
খুনসহ ২৫ মামলার আসামি ও পেশাদার সন্ত্রাসী শিমুল জবানবন্দিতে ‘শ্রেণিশত্রু’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, আদালতে দেওয়া জবানবন্দি তদন্তের একটি অংশ। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কী প্রমাণাদি পাওয়া যায়, তা–ও দেখা হবে। এ ছাড়া অন্য যেসব সহ-অপরাধী আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললেও অনেক কিছু বোঝা যাবে। তারপর তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে