বিশ্ববাজারে বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ফের ঊর্ধ্বমুখী। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি আবারো ৮০ ডলার ছাড়িয়েছে। মাঝখানে নিম্নমুখী হওয়ার পর ব্যারেলপ্রতি দাম পুনরায় ১৩ ডলার বেড়েছে। তেলের বাজারে এমন অস্থির পরিস্থিতি দেশের বাজারেও ফেলছে বিরূপ প্রভাব। বিশেষত বিদ্যুৎ, সেচ ও পরিবহন খাতে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি না থাকলেও বিশ্ববাজারে তেলের ঊর্ধ্বগতিতে দাম বাড়িয়ে এক প্রকার নিশ্চুপ অবস্থায় রয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতি নজর রাখছে জ্বালানি বিভাগ। তবে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে কিংবা কমে গেলে সে বিষয়ে সরকারের কী সিদ্ধান্ত হবে তা সুস্পষ্ট করে জানাতে পারেননি ওই কর্মকর্তারা।
এর আগে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা নিম্নমুখী হওয়ায় গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ডিজেল-কেরোসিনে লিটারপ্রতি ১-২ টাকা লাভ করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত তেল আমদানি ও বিপণনকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে যে হারে জ্বালানি তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে তাতে পুনরায় লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
জ্বালানি তেলের বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান অয়েলপ্রাইস ডটকমের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চে সরবরাহ চুক্তি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে আদর্শ ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের ব্যারেলপ্রতি বর্তমান দাম ৮৪ ডলার ৪১ সেন্ট ছাড়িয়ে গেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম ৮২ ডলার ৩৭ সেন্ট ছাড়িয়েছে। দিনের ব্যবধানে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১-২ ডলার করে বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত দুই মাসে তেলের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে। আর তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম ১৩ ডলার বেড়েছে।
এর আগে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর ব্যারেলপ্রতি ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ৭৩ ডলার ৫৭ সেন্ট এবং ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ৬৮ ডলার ৬১ সেন্ট।
বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় তেলের বাজারও পড়তির দিকে ছিল। কিন্তু ওমিক্রমের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় এবং কয়লা রফতানিতে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় হঠাৎ তেলের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণা। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, তেলের বাজার হঠাৎ অস্বাভাবিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চলমান সংকটই অন্যতম কারণ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, কভিড-উত্তরণ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু হওয়ায় তেলের বাজারদর বেড়ে গিয়েছিল। মাঝে কমে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র রিজার্ভ থেকে বাজারে তেল ছেড়ে দেয়ার ঘোষণায়। তবে নতুন করে তেলের বাজারে যে ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছে তার বড় কারণ ইউক্রেন সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এ ধরনের উত্তেজনা তৈরি হলে তেলের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ যুদ্ধের ক্ষেত্রে রসদ হিসেবে জ্বালানি তেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এদিকে বিশ্ববাজারে যে হারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে তাতে বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া কোনো উপায় দেখছে না জ্বালানি বিভাগ। তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি হওয়ায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়বে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তেলের বাজারে ঊর্ধ্বগতি কতদূর যাবে তা দেখা ছাড়া আপাতত কোনো উপায় নেই। তবে সেচ মৌসুমে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় যাতে কোনো ঘাটতি না হয় সেজন্য তেল আমদানিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থাপনাও ঠিক রাখা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বিপিসি তেল বিক্রিতে লোকসান করেছে। জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনে ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ২ টাকা ৯৭ পয়সা লোকসান হয় বিপিসির। পরের তিন মাসে সংস্থাটির লিটারপ্রতি লোকসান হয় যথাক্রমে ৩ টাকা ৭ পয়সা, ১ টাকা ৫৮ পয়সা ও ৫ টাকা ৬২ পয়সা। অক্টোবরে ডিজেল ও কেরোসিনে বিপিসির লোকসান প্রতি লিটারে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ টাকা ১ পয়সা। গত বছরের জুন থেকে অক্টোবরে এ দুই জ্বালানি পণ্যে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, দেশে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অন্তত ১৭ হাজার টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল।