মিয়ানমারে কেন এই অভ্যুত্থান? কোথায় সু চি?
সেনা শাসনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক বহুদিনের। ব্রিটিশ শাসন থেকে ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় এই ভূখণ্ড। এই বিপ্লবে ভূমিকা রাখেন দেশটির একমাত্র গণতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি, এনএলডির নেত্রী অং সান সু চির বাবা বোগোতে অং সান।
তবে স্বাধীনতা লাভের মাত্র এক যুগ পরেই ১৯৬২ সালে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে দেশটির ক্ষমতাগ্রহণ করে সামরিক নেতা নে উইন এর দল বার্মা সোস্যিয়ালিস্ট পার্টি। এরপর অর্ধশতক ধরে দেশটিতে জারি থাকে সেনা শাসন। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু দেশটির নতুন গণতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। দেশের বাইরে থাকা জাতির পিতার মেয়ে অং সান সু চিকে জন্মভূমিতে ফিরিয়ে এনে জনগণকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখায় এনএলডি। তবে মিয়ানমারে ফিরেই আটক হয় তাদের নেত্রী।
১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকেন সু চি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন নোবেলজয়ী এই নারী। ২০১১ সালে দেশজুড়ে আন্দোলনের মুখে তাঁকে মুক্তি দেয় সামরিক সরকার। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে একযোগে কাজ করতে সমঝোতায় পৌঁছায় দু পক্ষ। আয়োজন হয় সাধারণ নির্বাচন।
২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডির জয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সূর্য উঠেছে ভেবেই সু চিকে স্বাগত জানান বিশ্বনেতারা। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আপসহীন থাকবেন তিনি এমনটাই আশা ছিল সবার। অথচ সেনাবাহিনীর তৈরি সংবিধান মতেই পার্লামেন্টের ২৫ ভাগ আসন ধরে রাখে সেনা কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদসহ দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে সেনাবাহিনী। আর তাদের ইশারাতেই চলে অং সান সু চির পুতুল সরকার।
পুরোপুরি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় হাইব্রিড রেজিম বা স্বৈরশাসনের পথেই চলতে থাকে দেশ। অন্যদিকে কমান্ডার ইন চিফ ও স্টেট লিডার মিন অং লিয়াং এর নেতৃত্বে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে সেনাবাহিনী। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির নীরব অবস্থান বিশ্বজুড়ে তাকে বিতর্কিত করে।
এতকিছুর পরেও গণতন্ত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনতে সু চির ওপরেই ভরসা করে ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করে মিয়ানমারবাসী। যদিও ভোট বানচালের অভিযোগ করেন স্টেট লিডার মিন অং লিয়াংসহ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। নির্বাচনে ৩৪৬টি আসনে জয় পেয়ে এনএলডি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে পথে অনেকটাই এগিয়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংবিধান বাতিল করে সেনা অভ্যুত্থানের পথ বেছে নেয় সামরিকবাহিনী। সোমবার নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের জন্য এক বছরের জন্য ক্ষমতাগ্রহণ করে মিয়ানমার মিলিটারি। কার্যত দেশটির নতুন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন মিন অং লিয়াং।
সেনা অভ্যুত্থানের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও অং সান সু চি কোথায় আছেন তা জানা সম্ভব হয়নি। তার সঙ্গে বন্দি হওয়া নির্বাচিত সরকারের অপর মন্ত্রীদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সোমবার দেশটির ২৪ জন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছে সামরিক সরকার এবং সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ১১ জন মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা ও দাঙ্গা পুলিশকে টহল দিতে দেখা যায়। রাজধানীতে নজরদারি জারি রাখে হেলিকপ্টার। এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বড় কোন বিক্ষোভেরও খবর পাওয়া যায় নি।
সু চি তার সরকারি বাস ভবনে রয়েছে এমন বার্তাসহ একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হলেও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকেই। এনএলডির পক্ষ থেকে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হলেও সাড়া মেলে নি তেমন একটা। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের অচল অবস্থা নিয়ে শঙ্কায় গোটা বিশ্ব।❐
তথ্যসূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস, এবিসি নিউজ, বিবিসি ও ইন্টারনেট