যুদ্ধ জিইয়ে রাখছে যুক্তরাষ্ট্র, দায় মেটাচ্ছে সাধারণ মানুষ
সংঘাতের ৩০০ দিনের বেশি পেরিয়ে গেলেও ইউক্রেন যুদ্ধের স্থিতাবস্থা কাটেনি। কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয়েছে ক্রেমলিন। রাশিয়া সেখানকার চারটি অঞ্চল দখলে নিলেও পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। ফল ভোগ করতে হচ্ছে সারা বিশ্বকে। তবে যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই।
সবশেষ বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে যুদ্ধে জেতানোর জন্য সাহায্য অব্যাহত রাখবে। একই সময়ে কিয়েভের জন্য প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরও ১৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার ঘোষণা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। স্বনামধন্য মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম ট্রুট আউটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, মার্কিন অস্ত্রের কারণেই যুদ্ধ স্থিতাবস্থায় রয়েছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুনাফার স্বার্থে আর রাশিয়াকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে চাইছে। আর এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের।
ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে জোরালো হামলা চালাচ্ছিল রাশিয়া। তবে তাদের কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তখন পূর্বাঞ্চলে হামলা জোরদার করে তারা দোনেস্ক ও লুহানস্কের দখল নেয়। পরে দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন আর জাপোরিজ্জিয়াও তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সেপ্টেম্বরে ওই ৪ অঞ্চলে কথিত গণভোট আয়োজনের পর সেগুলোকে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করার চুক্তি স্বাক্ষর করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তবে পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেন দখলীকৃত অঞ্চলগুলোতেও প্রতিরোধ জোরালো করতে সক্ষম হয়। মাঝে কিছুদিন রুশ হামলার মাত্রা কমে এসেছিল। ইউক্রেনে শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে সেই হামলা আবারও জোরদার করেছে রুশ বাহিনী। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেন জো বাইডেন। পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন বলেন, আমরা দুজনই চাই যুদ্ধ শেষ হোক। আমি যেমনটা বলেছি, এই যুদ্ধ আজই থেমে যেতে পারত যদি পুতিনের সেই সম্ভ্রম থাকত এবং ঠিক কাজটি করতে পারতেন এবং তিনি যদি (সেনাদের) বলতে পারতেন, ‘ফিরে আসুন’। কিন্তু এমনটা ঘটবে না। তাহলে কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে যুদ্ধে জেতানোর জন্য সাহায্য করে যাবে।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় পেন্টাগন থেকে কিয়েভকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রসহ প্রায় ১০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র দেওয়া হবে। আর ইউক্রেন সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে বাকি ৮০ কোটি ডলারের তহবিল দেওয়া হবে। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে প্যাট্রিয়ট কবে নাগাদ পৌঁছাবে, তা অজানা। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এসব যুদ্ধাস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ প্রশিক্ষণ শেষ হতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে নোম চমস্কি বৃহস্পতিবারের সাক্ষাৎকারে ট্রুট আউটকে বলেছেন, মার্কিন প্রশিক্ষকসহ ৮০ জন হয়তো এই কাজে যুক্ত থাকবে। আর তারা সঙ্গত কারণেই রুশ হামলার বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। এর ফলে সংঘাত আরও ঘনীভূত হতে পারে। ভেস্তে যেতে পারে কূটনৈতিক সমাধানের যাবতীয় সম্ভাবনা।
এখন প্রশ্ন হলো, যুদ্ধে কি জিততে পারবে ইউক্রেন? যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল মার্ক মিলি নভেম্বরে বলেছেন, ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ সামরিক বিজয় ক্রেমলিন-কিয়েভ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তিনি সে সময় মন্তব্য করেন, ইউক্রেন এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে এবং শান্তি আলোচনার জন্য এটা উপযুক্ত সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শান্তি আলোচনার অনীহা কীভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তবে আলোচনার কোনো চেষ্টাই নেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার ট্রুট আউটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নোম চমস্কি বলেছেন, আমার ধারণা যৌথ বাহিনীর সাবেক প্রধান মার্ক জেনারেল মিলিই যথার্থ বলেছিলেন, কোনো পক্ষই চূড়ান্ত সামরিক বিজয়ে সক্ষম হবে না এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দুই পক্ষকেই চড়া মূল্য দিতে হবে।
সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেন, যুদ্ধ চলতে থাকলে প্রাথমিক শিকার হবে ইউক্রেন। রাশিয়ার আরও সৈন্য এবং সরঞ্জাম ব্যবহারের বিপরীতে উন্নত মার্কিন অস্ত্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে [টিকে থাকতে] ইউক্রেনকে একটা স্থিতাবস্থায় রাখতে পারে। তবে চমস্কির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সংঘাতের অনেক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর রাশিয়া এখন ইঙ্গো-মার্কিনদের যুদ্ধের স্টাইল অনুসরণ করে সরাসরি অবকাঠামো, জ্বালানি, যোগাযোগসহ একটি সমাজকে সচল রাখতে যা যা দরকার, তার সবকিছুতে হামলা করছে। এই মার্কিন বুদ্ধিজীবীর প্রশ্ন, ইউক্রেনের সমাজ ঠিক কতদিন এসব হামলার বিপরীতে টিকে থাকতে পারবে। ইউক্রেন ইতিমধ্যেই একটি বড় অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের সম্মুখীন। যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন যে মানুষ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যেতে পারে, তাদের অর্থ তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে, সম্ভাব্যভাবে জাতীয় মুদ্রাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে। বলেছেন চমস্কি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার সংবাদদাতা চার্লস স্ট্র্যাটফোর্ড কিয়েভ থেকে শুক্রবার জানিয়েছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার ছোড়া ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র অনেকটাই সফলভাবে মোকাবিলায় সক্ষম হচ্ছে। তবে আমরা এও জানি যে, এসব বোমা হামলা জ্বালানি অবকাঠামোকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কিয়েভ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষসহ সারা দেশের বহু মানুষ বিদ্যুৎবিহীন। তারা শীতে ঘর গরম করার উপায় পাচ্ছে না। কেননা ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
ইউক্রেনের বিদ্যুৎমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, গ্রীষ্মের আগে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সব গ্রিড সচল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে জ্বালানি অবকাঠামোতে আরও হামলার আশঙ্কা করছে তারা। এরই মধ্যে রাশিয়া হুমকি দিয়েছে, মূল্য বেঁধে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতে ২০২৩ সালে তারা তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেবে। চমস্কি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে শস্য ও সারের চালান ব্যাহত হওয়ার কারণে লাখ লাখ মানুষ অনাহারে ভুগছে। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে যে মূল্যবান সম্পদের প্রয়োজন ধ্বংসযজ্ঞে তা নষ্ট হচ্ছে, রাশিয়া-ইউরোপ স্বাভাবিক সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে পড়ছে এবং একই সঙ্গে রুশ সহযোগী হিসেবে চীনের সঙ্গেও ইউরোপের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চীনের বিরুদ্ধেও ভার্চুয়াল যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বাইডেন প্রশাসন। ওয়াশিংটন বেইজিংয়ে প্রযুক্তি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ইউরোপীয় শিল্প, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের উন্নত চিপ-উৎপাদন শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। নোম চমস্কির মতে, পুতিনের আত্মঘাতী যুদ্ধবাজির সিদ্ধান্তে ইউরোপ পুরোপুরিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পকেটস্থ হয়েছে। সঙ্গে মার্কিন অর্থনীতিতেও হাওয়া লেগেছে। সে দেশের সামরিক উৎপাদন, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই মুনাফাবাজি আর নিজেদের শক্তিক্ষয়ের বাস্তবতা কি রাশিয়া মেনে নেবে? কয়েক মাস আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, রুশ ডকট্রিন অনুযায়ী ‘যখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে’ তখন তারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত। বাইডেনও স্বীকার করেছেন, পুতিনের বক্তব্যকে তিনি তামাশা হিসেবে দেখছেন না। ক্রেমলিন ইউরোপের দোরগোড়ায় বেশ কয়েকটি পরমাণু বোমা মোতায়েন রেখেছে বলেও কিছুদিন আগে খবর দিয়েছে মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইক। পুতিন হুমকি দিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের জন্য আসছে দশক হতে চলেছে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’। তা সত্ত্বেও সমঝোতার কোনো চেষ্টা নেই বাইডেন প্রশাসনের।
বিকল্প ধারার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ডেমোক্র্যাসি নাউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজনীতি বিশ্লেষক মেডেয়া বেঞ্জামিন কিছুদিন আগে বলেছেন, বারবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রচেষ্টা ভেস্তে দেওয়া হয়েছে। ওয়ার ইন ইউক্রেন : মেকিং সেন্স অব অ্যা সেন্সলেস কনফ্লিক্ট বইয়ের লেখক মেডেয়া বেঞ্জামিন তার সহলেখক নিকোলাস জে এস ডেভিসের সঙ্গে মার্কিন সংবাদমাধ্যম জিনেটে লেখা আরেক বিশ্লেষণে বলেছেন, রাশিয়া যদি নিজেদের সীমানায় ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যায় তবে তারা তাদের ঘোষিত ডকট্রিন অনুযায়ী একে পরমাণু হামলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তা সত্ত্বেও বাইডেন আমেরিকা ও বিশ্বের জনসাধারণের জন্য কোনো সতর্কতা জারি করেননি বা মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘোষণা করেননি। সবমিলে মনুষ্য প্রজাতির ভাগ্য চিকন সুতোয় ঝুলছে। এদিকে বৃহস্পতিবারের সাক্ষাৎকারে নোম চমস্কি বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী দুই যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়াকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করার জন্য যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিচ্ছে; যদিও তাদের অভ্যন্তরীণ বৃত্তেও এ নিয়ে বিরোধিতা রয়েছে।