শামীমা সুলতানার দুটি কবিতা
শামীমা সুলতানা সাহিত্য জগতের অন্তর্জাল ধারার খুব পরিচিত নাম। চঞ্চল অথচ ধীর স্বভাবের শামীমার বেছে বেছে শব্দ নির্বাচনে নির্মিত মার্জিত বাক্যগুলোয় ঠিকরে ওঠে ভাষা শৈলী। সেসব শাণিত বাক্য ধাঁধিয়ে উঠে পাঠকের মানস দখল করে নেয়। পেশায় শিক্ষক শামীমা কবিতায় স্বচ্ছন্দ হলেও অসাধারণ গদ্যও লেখেন। বিশেষত ছোটগল্পে তাঁর মৌলিকত্ব লক্ষ্য করবার মতো। মানুষের জীবনের নানা অসঙ্গতি, প্রকৃতি এবং প্রেম ইত্যাদি লেখার উপজীব্য কেবল নয়, লেখায় তিনি খুব সাবলীলতায় সেসবের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়ে তুলে ধরেন সহজাত সহজতায়।
এখানে শামীমা সুলতানার দুটি ভিন্নধারার কবিতা প্রকাশিত হলো। প্রথম কবিতা একজন কমরেড রফি মুক্তিযোদ্ধা কমরেড রফিকে নিয়ে রচিত ও উৎসর্গিত। কমরেড রফি বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের নৃশংস নির্যাতনে শহীদ হন। কবিতাটি এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। পরের কবিতা দীপ্তিময় সূচনায় প্রবল হতাশাকে জয় করে নতুন সূচনায় আলোর পানে ছুটে চলতে চাওয়া পাঠককে জানিয়ে দেয়- জীবন কখনও পরাজিত হয় না। কেবল পথ বদলায়।
আগামীতে আমরা শামীমা সুলতানার আরও রচনা প্রকাশে সচেষ্ট হবো।
–নির্বাহী সম্পাদক
রাতটির ক্রূর আঁধারে ছিল
বুক হিম করা নিশ্ছিদ্র নীরবতা।
দেয়াল ঘড়িটিই শুধু
টিক টিক করে চলেছে সব অঘটন অবজ্ঞায় পদদলিত করে।
পুত্রশোকে মূর্ছিত মায়ের
পাঁজরের হাড়গুলো কেউ নিঃশব্দে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছিল ।
করাল রাতের ঊষা চোখ মেলতেই দেখল সারি সারি শবদেহ শহরটায়।
জীবিতের দলও যেন গুটিসুটি মেরে
রয়েছে মৃতের সারিতে।
চৌরাস্তার ওপর পালিত হচ্ছে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম উৎসব।
সুউচ্চ খুঁটির চূড়ায় কমরেড রফির কর্তিত মস্তক স্থাপিত সেথায়,
আর ধড়খানির অসহ পতন ভৈরবে।
পাক হায়েনা আর তাদের দোসরদের পৈশাচিক হাসিতে,
শহরের ইট, কাঠ, পাথরও যেন ক্রোধে হচ্ছিল উন্মত্ত।
সেদিনের কাক শকুনিরা পর্যন্ত থেকেছে রত
যে কোনও প্রয়াতের প্রত্যাখানে।
দানব নয়, মানবের অন্তরে অন্তরে বাজছিল প্রতিশোধের দামামা।
সে প্রতিশোধ স্বদেশী নরাধমের বিশ্বাসঘাতকতার
এক বিপ্লবীর পবিত্র শরীর নারকীয়তায় ব্যবচ্ছেদের
যে শরীরটার হৃদপিন্ড জুড়ে ছিল স্বাধীনতার অঙ্গীকার।
রক্তের শেষবিন্দুও মাতৃভূমির ঋণশোধে ছিল বদ্ধপরিকর।
নিরবচ্ছিন্ন নিপীড়নের প্রাণত্যাগে
চিত্ত ছিল তবুও দ্বিধাহীন।
রফি এক এষনীয় ক্ষনজন্মার নাম-
অতর্কিতে জ্বলে ওঠা গনগনে উমেদ,
এক মহিমান্বিত হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যান।
যার রক্তাক্ত শিরের রূপান্তর-
আজকের গর্বিত পতাকা।
যার নামের গ্রন্থাগার আজো-
নবীন কিশোরকে দেয় আলোর দিশা।
সহস্র কোটি মানুষ পদচিহ্ন রেখে যায়-
রফি সড়কের উদাত্ত বক্ষতটে ।
অস্তিমান দিন তাই আজো ঋণী অতীত ইতিহাসের কাছে,
কমরেড রফিদের রক্তস্রোতের নিগূঢ়তার মাঝে!
রাক্ষুসে ভর সন্ধ্যেটা আমার বেঁচে থাকাটুকু গিলে নেয় রোজ-
আঁধার ঘনিয়ে এলে ব্যর্থতাগুলো আমায় চোরাবালিতে ডোবায়।
অতলে তলিয়ে যেতে যেতে হাতড়ে বেড়াই জোনাকির শরীর,
গহীন রাতে নীরবতার সরব আমায় কুরে কুরে খায়,
সজোরে চেপে ধরি বহিকর্ণ,
তবু রুগ্ন কুকুরটির গোঙানির শব্দ পৌঁছে যায় অন্তকর্ণ অবধি।
দূরে পুলিশের বুটের শব্দ ঘুরে বেড়ায় শূন্য রাস্তায়,
মস্তিষ্কে আমার টলমল করে ওঠে ঘোলা জল।
বিবশ আমি নেমে পড়ি মাঝ রাস্তায়-
পতিতার চোখ হঠাৎ অশরীরী লাগে।
ঘূর্ণিঝড়ের মত আমার শরীরের ভেতর থেকে কি যেন উল্টে আসে।
দেবদারু গাছ থেকে প্যাঁচাটি অবিরাম অলক্ষুণে ডেকে যায়,
আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে,
সাদা কাশফুল ক্রমশ প্রগাঢ় কালোতে রূপান্তরিত হয়।
– তবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রই ভোরের পানে,
সূর্যের রশ্মিগুলো দিয়ে নির্মিত হচ্ছে সফলতার প্রকান্ড সেতু –
দম্ভভরে হাঁটতে চাই সে সেতুর ওপর-
কাল রাত থেকে পৌঁছতে চাই জ্বলজ্বলে প্রভাতে!