সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস
এই কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সাউথ এশিয়ান গেমস ফুটবলে নেপালকে হারিয়ে জুয়েল রানার নেতৃত্বে সেই ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন আলফাজরা।
২৩ বছর পর আবার সেই কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেয়িামে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস লিখলো বাংলাদেশ।
এবারের ইতিহাসের রচয়িতা সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া, মনিকা, মাসুরা, আঁখি, তহুরা, রূপনারা। দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মঞ্চে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দেশকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসালেন তারা। গতকাল ইতিহাস গড়ার ফাইনালে কৃষ্ণা রানী সরকার দুটি ও শামসুন্নাহার জুনিয়র এক গোল করেন।
অনিতার গোলে ব্যবধান কমায় নেপাল। টুর্নামেন্টে আট গোল করে সেরার মুকুট পরেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সাফল্য আছে। যদিও সিনিয়র পর্যায়ে শিরোপা অধরাই থেকেছে এতদিন। বয়সভিত্তিক আসরগুলোতে নেপালকে হারালেও জাতীয় দলের কাছে নেপাল ছিল অজেয়। এর আগে সাফ, এসএ গেমস ও অলিম্পিক বাছাই মিলিয়ে দুই দল আটবার মুখোমুখি হয়েছে।
ছয়বারই জিতেছে নেপাল, বাকি দুটি ম্যাচ ড্র হয়। তার ওপর নেপালের মেয়েরা খেলছে নিজেদের মাঠে। ১৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন দশরথের গ্যালারি ছিল কাণায় কাণায় পূর্ণ। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে ভারি বৃষ্টিতে মাঠও ছিল প্রায় খেলার অনুপযোগী। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা একপাশে রেখে বাংলাদেশ ফাইনালে খেলছে মনভরানো ফুটবল।
যার শুরুটা হয় ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই। প্রথম মিনিটে মারিয়া মান্দার বক্সের বাইরে থেকে দুরপাল্লার শট গোলরক্ষক আটকালেও পুরোপুরি গ্লাভসে জমাতে পারেননি। আলগা বলে স্বপ্নার শটও কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আঞ্জিলা থুম্বাপো সুব্বো। এরপরই পাল্টা আক্রমণে ওঠা নেপালের প্রচেষ্টা অনেকটা লাফিয়ে গ্লাভসে নেন রুপনা চাকমা।
নবম মিনিটে শরীর ঘুরিয়ে মারিয়ার জোরালো ক্রসে বক্সের ভেতর বল পেয়ে যান কৃষ্ণা; ভারত ম্যাচে এক গোল করা এই ফরোয়ার্ডের শট সরাসরি যায় গোলরক্ষকের গ্লাভসে। ডান পায়ের চোট থাকায় সিরাত জাহান স্বপ্নার খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে খেলতে নামে বাংলাদেশ। দশম মিনিটে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়েন স্বপ্না; বদলি নামেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। চতুর্দশ মিনিটে দুর্দান্ত গোলে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দে ডানা মেলে বাংলাদেশ।
সানজিদা খাতুনের শট এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে পেয়ে যান মনিকা। একজনকে কাটিয়ে বাইলাইনের একটু উপর থেকে তিনি ক্রস বাড়ালেন বক্সে, শামসুন্নাহারের দুরন্ত ফ্লিকে বল জাল খুঁজে পায়। টুর্নামেন্টে নেপালের জালে এটাই প্রথম গোল।
এরপর গোল শোধে মরিয়া হয়ে ওঠে নেপাল। মাঝমাঠে মারিয়া-মনিকার নিয়ন্ত্রণে একটু টান পড়ে; ফলে বাংলাদেশের রক্ষণে চাপ দিতে থাকে স্বাগতিকরা। কিন্তু পোস্টের নিচে রুপনা ছিলেন দারুণ ক্ষিপ্র, বিশ্বস্ত। ২৩তম মিনিটে অনিতার শট প্রথম দফায় আটকে দ্বিতীয় দফায় গ্লাভসে নেন তিনি। ৩৪তম মিনিটে আবারও রুপনার ঝলক। বক্সের বাইরে অনিতার ছোট ফ্রি কিকে দিপা সাশির শট ঝাঁপিয়ে পড়ে কর্নারের বিনিময়ে ফেরান গোলরক্ষক। এই কর্নার থেকে ডিফেন্ডারদের দৃঢ়তায় বেঁচে যায় বাংলাদেশ। গোললাইন থেকে বিপদমুক্ত করেন ডিফেন্ডাররা।
৪১তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের ভুলে বল পেয়ে অধিনায়ক সাবিনা পাস বাড়ান কৃষ্ণার উদ্দেশে। প্রথম ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটু এগিয়ে বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে লক্ষ্যভেদ করেন এই ফরোয়ার্ড। দ্বিতীয়ার্ধে নেপাল ঘুরে দাঁড়ানোর কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিল। ম্যাচের ৭০ মিনিটে অনিতার গোলে ব্যবধানও কমায় স্বাগতিকরা। তবে দুরন্ত-দুর্বার বাংলাদেশকে আটকে রাখতে পারেনি।
প্রতি আক্রমণ থেকে ৭৭ তম মিনিটের গোলে নেপালকে কোণঠাসা করে ফেলে বাংলাদেশ। সতীর্থের থ্রু পাস ধরে ঠাণ্ডা মাথায় নেপাল গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়া দূরের পোস্টে বল পাঠিয়ে উল্লাসে মাতেন কৃষ্ণা। এরপর ঘড়ির কাঁটা যতই গড়িয়েছে, নেপাল একটু একটু করে ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাফে তো বটেই নেপালের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথম জয়ের গল্প লিখে মাঠ ছাড়ে লাল-সবুজের মেয়েরা।
নেপালের বিপক্ষে আগের ৮ দেখায় বাংলাদেশের হার ছিল ৬টি, ড্র দুটি। সাফের সবশেষ দেখায় ২০১৯ সালে বিরাটনগরে সেমিফাইনালে স্বাগতিকদের কাছে বাংলাদেশ হেরেছিল ৩-০ গোলে। গত বছর সেপ্টেম্বরে নেপালে খেলা দুই ম্যাচের একটিতে ২-১ ব্যবধানের হার, অন্যটি ছিল গোলশূন্য ড্র। প্রথম শিরোপা জয়ের গল্প লেখার পথে বিরাটনগরের হারের মধুর প্রতিশোধও নেওয়া হয়ে গেল বাংলাদেশের!