সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই বড় চ্যালেঞ্জ
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আগামী ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, এ নিয়ে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মেয়র পদে নির্বাচন দলীয় প্রতীকে এবং কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্বাচন নির্দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হবে।
সন্দেহ নেই, ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাদশ জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার কাঠামোর কয়েকটি স্তরের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বিষয়গুলো আলোচনায় রয়েছে। শুরুতেই যে পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাতে আশা করা হচ্ছে, নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এমন প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে এই নির্বাচন সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এই সত্য এড়ানো কঠিন যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভোটাধিকার রক্ষার ব্যাপারে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে আমি বলব, মানুষের হূত আস্থা পুনরুদ্ধারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি সুযোগ এনে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের সামনে। এ জন্য সর্বপ্রথম তাদের অবস্থান প্রশ্নমুক্ত করতে হবে। তাদের যে সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে, এর প্রয়োগ করতে হবে যথাযথভাবে। গণতন্ত্রে নির্বাচন হলো অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে এর পরিণতি কতটা বিরূপ হতে পারে, এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তো আমাদের আছেই। আমাদের দেশে সুযোগ-সন্ধানীরা প্রায় সবসময় ওত পেতে থাকে। বিশেষ করে যে কোনো নির্বাচন এলেই তাদের অপতৎপরতা আরও বেড়ে যায়- এও আমাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়; সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট সব মহলসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দায়ও কম নয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহল যদি চায়, স্বচ্ছ ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন হোক; তাহলে অবশ্যই এর ইতিবাচক প্রভাব পরিস্ম্ফুটিত হতে বাধ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা প্রীতিকর নয়। নির্বাচন কমিশনের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর যে সুযোগটা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে নিয়ে এলো, তা তারা হাতছাড়া করবে না। এটি আমাদের প্রত্যাশা।
বিভক্ত ঢাকায় একই সঙ্গে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেদিকে সবার দৃষ্টিই প্রখর। অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত হলেও সত্য; জাতীয় রাজনীতি, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতায় কখনও কখনও কতটা বিরূপ ছায়া ফেলেছে; এই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাও আমাদের অনেক ক্ষেত্রে শঙ্কামুক্ত রাখে না। ইতিপূর্বে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, এর প্রত্যেকটি পর্বেই উঠেছে একই অভিযোগ। অভিযোগ হলো- ওই নির্বাচনগুলোয় মানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। দলিল-দস্তাবেজে অনেক সময় সবকিছুর নিখুঁত প্রমাণ হাজির করা না গেলেও মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু নানা ক্ষেত্রেই অপ্রীতিকর। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি, আসছে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এক দিনের উৎসব হলেও এর মধ্য দিয়ে যাতে এমন শুভ প্রত্যয় প্রতিফলিত হয়, যার প্রভাব হবে জনগণের জন্য কল্যাণকর। বলতে গেলে প্রায় এক ধারার রাজনীতি চলছে দেশে। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলের সংজ্ঞাসূত্র মতে এর যথার্থতা নির্ণয় করা কঠিন। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এমন অবস্থায় নেই, যার ফলে যে কোনো অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা শক্ত অবস্থান নিয়ে তা শোধরানোর পথ বাতলাতে পারবে। কাজেই এ ক্ষেত্রে এসব ব্যাপারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহলকেই রাজনৈতিক স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা এবং সমঅধিকার নিশ্চিতকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। নির্বাচনে সমতল ভূমি নিশ্চিত হওয়াটা খুবই জরুরি বিষয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও কার্যকর পদক্ষেপের বিষয়টি সমভাবেই জরুরি।
এই নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে ইতোমধ্যে কথা উঠেছে। সিইসি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে তারা সুফল পেয়েছেন। তাই তা ধরে রাখতে চাইছেন এবং তারা এর বিস্তৃতকরণের পক্ষে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ইভিএম নিয়ে অংশীজনের অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ব্যাপকভাবে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণে এখনও আমাদের সক্ষমতা কিংবা প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এও বলেছেন, ‘যদি সবাই বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) দিয়ে ভালোভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা যায় না, তাহলে করব না।’ অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনই এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনকে আরও ভাবা প্রয়োজন বলে মনে করি এবং এ ব্যাপারে ঐকমত্য জরুরি। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং সর্বোপরি স্বচ্ছ নির্বাচন না হলে শুধু যে গণতন্ত্রের সৌন্দর্যহানিই ঘটে তাই নয়; এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব দেশ-জাতির জন্য অমঙ্গলই বয়ে আনে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সিটি ভোটে হারলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। কিন্তু অতীতের স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে বহু ক্ষেত্রেই এর বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তো বটেই, একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন মহল যদি যথাযথ ভূমিকা পালন না করে, তবে অবাধ নির্বাচন করা কঠিন। নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনই সর্বেসর্বা বটে। কিন্তু সরকারের কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা ছাড়া শুধু নির্বাচন কমিশন নিজ শক্তিবলে প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন করবে কী করে? আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থা তো সে রকমই। তবে নির্বাচন কমিশনকে নির্মোহ ও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর তাদের নির্ভরতা কুফলের খতিয়ান বিস্তৃত করবে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক রাজনীতি, ভিন্নমতাবলম্বীদের অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কম ক্ষত সৃষ্টি হয়নি। এই ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা নানা মহলের তাগিদ সত্ত্বেও জোরদারভাবে নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের সদিচ্ছাটাই মুখ্য। সরকারি দল চাইলে সবার অধিকার নিশ্চিতকরণসহ ভীতিমুক্ত, চাপমুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তোলা মোটেও কঠিন কোনো বিষয় নয়। সবার কথা শুনতে হবে, আমলে নিতে হবে। যে কোনো অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় করে করণীয়টুকু সেভাবেই করতে হবে। দেশের রাজনীতিতে ভঙ্গুর পরিস্থিতি নেই- এ কথা বলা যাবে না। সুশাসন, ন্যায়বিচারের পথে এখনও যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। সুশাসন নিশ্চিতকল্পে যা যা করণীয়, সেসব কথার কথা হয়ে থাকলে তো চলবে না। আমরা যেন সেই ইতিহাস ভুলে না যাই যে, অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ রচিত হয়েছিল। তাই অবাধ নির্বাচনের পথে যত রকম প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, সেসবের নিরসন ঘটাতেই হবে। যদি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনই একের পর এক হতে থাকে, তাহলে এর ফল ভালো হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য তা মারাত্মক হুমকি- এ কথা যেন দায়িত্বশীলরা ভুলে না যান। তাই আমি বলব, আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকার কাঠামোর একটি স্তরের নির্বাচন হলেও তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোট ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি দেশের সিংহভাগ মানুষের যে অনীহা-অনাস্থা জন্মেছে, এর নিরসনের পথ সৃষ্টি হতে পারে এর মধ্য দিয়েই।
আমাদের শুভ প্রত্যাশা যেন মাঠে মারা না যায়, তা নিশ্চিত করার দায়টা দায়িত্বশীলদের আমলে রেখেই এগোতে হবে। নির্বাচন কমিশন অতীতের সব দাগ মুছে দেওয়ার সুযোগটি কাজে লাগালে আমাদের ভবিষ্যতের পথ মসৃণ হবে। মাঠ সমতল করার ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ- এ কথার পুনরাবৃত্তি হলেও জোর দিয়ে তা আবারও বলছি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সারাদেশে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল উপজেলা নির্বাচন। সেই অধ্যায়ও আমাদের কাছে সুখকর নয়। কাজেই ইসির সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাতে তাদের জয়ী হতে হবে। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে এর বিকল্প নেই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি আগেও ইসির তরফে বহুবার ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর প্রতিফলন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। বরং বিপরীত চিত্রটাই অনেক ক্ষেত্রে খুব পুষ্ট। এমনটির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সহিংসতামুক্ত নির্বাচন উপহার দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদেরও দায়দায়িত্বের কথা স্মরণ রাখতে হবে। আমরা দৃষ্টান্তযোগ্য নির্বাচন দেখতে চাই।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন