অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হলেও স্বায়ত্তশাসন কমছে হংকংয়ের!
কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব থেকে বের হয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটতে শুরু করেছে চীনা নিয়ন্ত্রণাধীন বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকং। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি দৃশ্যমান হলেও একই সময়ে কমতে শুরু করেছে এর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। খবর এপি।
বহু বছরের বিক্ষোভ, উপনিবেশিক শাসন, নির্যাতন ও মহামারী-সংক্রান্ত বিধিনিষেধের মধ্যে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে এখানকার অধিবাসীদের। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বলছে, অঞ্চলটি ক্রমেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে এগোচ্ছে।
হংকংয়ের অধিবাসীরা অঞ্চলটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। লিয়াং ট্যাট-চং নামের এক ট্যাক্সি চালক জানান, মহামারীর আগে তিনি যে পরিমাণ আয় করতেন, বর্তমানে প্রায় সমান আয় করছেন।
মহামারীর পর প্রথমবারের মতো শহরটি গত মার্চে ২০ লাখের বেশি পর্যটককে স্বাগত জানিয়েছে। এতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হওয়ার পথে থাকলেও রাজনৈতিক সংকট কাটেনি। ২০১৯ সালে দেশটিতে সংঘটিত হয় বড় ধরনের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ওই বিক্ষোভের পর থেকে শহরটির জনগোষ্ঠী বিভক্ত হয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষ মিছিল করেছে, অনেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। সরকার বেইজিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ ছিল আন্দোলনকারীদের।
ট্যাক্সি চালক লিয়াং জানিয়েছেন, তিনি কখনো তার ট্যাক্সিতে রেডিও চালু করেন না। কারণ সরকারি সংবাদ বা জনসংযোগ খবরে তার যাত্রীরা রেগে যেতে পারে। সরকার সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘাত এড়াতে বন্ধুদের সঙ্গেও ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হয়।
২০১৯ সালের বিক্ষোভের পর বেইজিং ঘোষণা করে, সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের হংকং পরিচালনা করতে হবে। ওই সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থায় চীনের অনুগতদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। চালু করা হয় একটি বিশেষ জাতীয় নিরাপত্তা আইন। আইনে বিভিন্ন ধরনের মতবিরোধকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। হংকং সরকার আইনটি ব্যবহার করে বিরোধীদলীয় সাবেক আইন প্রণেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করেছে। চীনা সরকারের সহায়তায় অঞ্চলটির ক্ষমতাসীনরা স্বায়ত্তশাসনকে নির্মূল করছেন বলে দাবি বিক্ষোভকারীদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে হংকংয়ে বসবাসের অর্থ হলো দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ মানবিক অনুভূতি প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা দমন করতে হবে। অনেকেই জানিয়েছেন, তারা এখন ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রতিই বেশি মনোনিবেশ করছেন।
এখানকার অধিবাসীরা কভিডের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কয়েক বছর পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি বাড়তে দেখছেন। কিন্তু যখন কোনো রাজনৈতিক বিষয় আসে তখন সেখানে আশাব্যঞ্জক কোনো দৃশ্য দেখা যায় না। স্থানীয়রা বলছেন, চীনশাসিত সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশটির যে স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতা ছিল সেটি এখন চিরতরে হারিয়ে গেছে বলেই মনে হয়।
অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে হংকং প্রশাসন বলছে, সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। জনবহুল অঞ্চলটিতে খুচরা বিক্রয় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জিডিপির আকার। এছাড়া বেকারত্বের হার কমে ৩ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে, শহরটি ৪৪ লাখের বেশি পর্যটক পেয়েছে। আগের প্রান্তিকে তুলনায় এটি ১২ গুণ বেশি এবং মহামারী পূর্ব স্তরের প্রায় ৩০ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছে।
ডিম সাম চেইন টিম হো ওয়ানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক কুই-পুই জানিয়েছেন, বর্তমানে তার ব্যবসা কিছুটা সুফল পাচ্ছে। বিদেশী পর্যটকরা তার রেস্তোরাঁয় আসছেন। বিগত তিন বছরে যা দেখা যায়নি। এরই মধ্যে মহামারী-পূর্ব স্তরের প্রায় ৮০ শতাংশেরও কাছাকাছি আয় হয়েছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দৃশ্যমান হচ্ছে।
হংকংয়ের ব্রিটিশ চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারম্যান অ্যানি কের বলেন, হংকংয়ে বিক্রয়কেন্দ্র চালুর বিষয়ে অনেকগুলো ব্রিটিশ কোম্পানি অনুমতি চেয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম দুই মাসে হংকংয়ের আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এর সদস্যরা অঞ্চলটিতে ব্যবসায়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
হংকংয়ের রাজপথে রাজনীতির একটি উজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল। স্থানীয় সমস্যা সমাধানেও ব্যাপক পদযাত্রা দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে সেটি বিলুপ্ত প্রায়। গত মার্চে সাইরাস চ্যান নামের এক ইভেন্ট আয়োজক জানিয়েছেন, পুলিশ যেকোনো আয়োজনে সর্বোচ্চ ১০০ জন উপস্থিতির অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালের বিক্ষোভের মতো কালো পোশাক পরার বিরুদ্ধেও সতর্ক করা হয়েছে। স্লোগানের বিষয়েও আছে কড়াকড়ি।
২৬০টির বেশি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নিয়ে গঠিত অঞ্চলটির প্রধানতম দ্বীপের নাম হংকং। সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশিক অঞ্চলটি ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই এক বিশেষ চুক্তির ভিত্তিতে চীনের কাছে হস্তান্তর হয়। এরপর চীনের ‘এক দেশ দুই নীতির’ ভিত্তিতে আলাদা মুদ্রা ও শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে থাকে।