আনিস ভাই
পবিত্র সরকার
‘আনিস ভাই’ নামেই ডাকতাম তাকে, আমাকেও তিনি নাম ধরেই ডাকতেন। অনুজের প্রতি স্নেহের যে উষ্ণতা তা আমার জন্য, যেমন আরও অনেকের জন্য, সব সময় প্রস্তুত থাকত বাড়িতে, অনুষ্ঠানে, আরও ব্যক্তিগত নানা সাক্ষাতে, একটি গ্রন্থের যুগ্ম সম্পাদনার কাজে- দুই দেশে (বা বাইরেও, যেমন জাপানেও তার সঙ্গে গেছি ২০১৫ সালে), যেখানেই হোক। আমার চেয়ে বয়সে মাত্র এক মাস দশ দিনের বড়; কিন্তু তার দেশ ও সময়কে অতিক্রম করে যে বিপুল মহিমা তৈরি হয়েছিল, তাকে স্পর্শ করা আর কোনো বাঙালির পক্ষে সম্ভব নয়।
আর এ লেখা ব্যক্তিগত শোকের বিবৃতিও নয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যু দুই বাংলার সংস্কৃতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি করল তা ‘ইন্দ্রপতন’, ‘বনস্পতির সরে যাওয়া’ বা ‘মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যাওয়া’- এসব বয়ানের মধ্য থেকে ঠিক ধরা যাবে না। তিনি ছিলেন দুই বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ ‘মানবিক’ সংস্কৃতির প্রধান অভিভাবক।
ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার পেয়েছিলেন (২০১৪) তার এ উদার সাংস্কৃতিক মানবিকতায় দুই দেশের মধ্যে এক গভীর সৌহার্দ্য স্থাপনে তার নিয়ত চেষ্টার জন্য। গত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে এটা লক্ষ করে এসেছি যে, যখনই এখানে কোনো আলোচনা-চক্র বা বিদগ্ধ সাহিত্য-সভার কথা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভাবা হতো এবং সেটাকে একটা ‘আন্তর্জাতিক’ চেহারা দেয়ার পরিকল্পনা করা হতো, তখন যে নামটি উদ্বোধক হিসেবে সবার আগে মুখে উঠে আসত, সেটি আনিস ভাইয়ের, আর কারও নয়। এ যেন শেক্সপিয়রকে নিয়ে ম্যাথিউ আর্নল্ডের সেই ভাবনা- Others abide our question, thou art free. এবং একবার নামটা উঠে পড়া মাত্র, সে সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা কোনো সীমানা থেকে উচ্চারিত হতো না। শুধু একটাই উদ্বেগ হয়তো কেউ প্রকাশ করতেন, তিনি সময় দিতে পারবেন কি?
কিন্তু খুব অসম্ভব না হলে তিনি সময় দিতেন। জানি না, জন্মের (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭) স্থান কলকাতা বলেই কিনা, এ বাংলার প্রতি ছিল তার এক গভীর মমতা, এ বাংলা থেকে কোনো ডাক এলে তিনি প্রত্যাখ্যান করার কথা ভাবতেনই না। তার বিপুল পাণ্ডিত্য তাকে সামাজিকভাবে দুষ্প্রাপ্য করে তোলেনি, দুই বাংলার কোথাও না। বাংলাদেশে তিনি ‘জাতীয় অধ্যাপক’ ছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ শিক্ষক, তিনি এ শিক্ষকের পরামর্শ নিতে সব সময় এগিয়ে আসতেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সব রকম সাংস্কৃতিক ঘটনায় উপস্থিত থাকতেন, ডাকলে প্রথমেই তাকে পাওয়া যেত। সভা, সমিতি, সঙ্গত প্রতিবাদ, আলোচনা, সংবর্ধনা, বই উদ্বোধন (ও বাংলায় তাকে বলে ‘মোড়ক উন্মোচন’)- সভাপতি বা উদ্বোধক কে হবেন? অনিবার্যভাবে আনিস ভাই। এ নিয়ে তার স্ত্রী বেবি ভাবী (শ্রীমতী সিদ্দিকা জামান), পুত্র আনন্দ এবং অন্যান্য প্রিয়জনের উদ্বেগ ছিল; কিন্তু আনিস ভাই, একান্ত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে অবরুদ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত, কাউকেই ফেরানোর কথা ভাবতেন না।
তাকে যেমন দুই বাংলার সবাই আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক অভিভাবক বলে অবিকল্পভাবে মেনে নিয়েছিলাম- তার একটি জীবন-তথ্যচিত্রের নাম উপযুক্তরূপেই ‘বাতিঘর’- তিনি নিজেও আমাদের এ প্রাপ্য আশ্বাসটুকু দিতে কখনও ক্লান্ত হতেন না। তিনি আমাদের মধ্যে আছেন, এ কথাটা আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় প্রতিদিন সত্য হয়ে উঠত।
শুধু একটি স্থিরমূর্তি নয়, এক সক্রিয়, সজীব, উচ্চারণময় অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্বটি এবার কালের নিয়মে অপসৃত হল। আমরা খবর রাখছিলাম তার, ফেসবুকে বাড়ি থেকে আশ্বাসও এসেছিল যে, অবস্থার উন্নতি ঘটছে। কিন্তু কিডনি কাজ করছে না দেখে একটু উদ্বেগ হচ্ছিল। সেই উদ্বেগ শোকে পরিণত হল। ওই প্রায় শালপ্রাংশুমহাভুজ অথচ শিশুর মতো সরল ও শান্ত মানুষটির প্রয়াণে যে শূন্যতা নেমে এল বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্তিত্বে, তা আর পূরণ হওয়ার নয়। দক্ষিণ এশিয়ার বিবেকের একটি কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল।
বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর মূল্যবান গবেষণা তিনি অনেক করেছেন। দেশে-বিদেশে এজন্য তার বিপুল সমাদর হয়েছে। ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ঢাকাতেই তার পিএইচডি, কিন্তু উত্তর-গবেষণা করেছেন প্রচুর, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৪-৬৫), লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে (১৯৭৪-৭৫)। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, বিশ্বভারতী, রবীন্দ্র-ভারতী ইত্যাদি কত বিশ্ববিদ্যালয় যে তাকে ডেকেছে, সম্মান আর পুরস্কার দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এ ভাষাসৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধাটি সঙ্গতভাবেই তার দেশের কাছে বিপুল সম্মান পেয়েছেন, বহু পুরস্কার তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেরাই ধন্য হয়েছে।
আমরা তার গবেষণাগ্রন্থগুলোকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করে দেখতে চাই। তার প্রথম গবেষণা ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ (১৯৬৪) বাংলা সাহিত্যের একটি বিকল্প এবং অবহেলিত ধারার সন্ধান আর আবিষ্কার করেছে। হিন্দু সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের কাছে, দীনেশচন্দ্র সেন প্রভৃতির ব্যতিক্রম সত্ত্বেও, অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলমানদের মনের কথা, তাদের সাহিত্য কিছুটা পাশে সরানো ছিল; অধ্যাপক আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান- অনেকেই সেই কথাগুলোকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন, তাতে সমগ্র বাঙালিরই উপকার হয়েছে। পরে ‘বাংলার নারী, সাহিত্যে ও সমাজে’ (২০০১) বইটিও অনেকটা একই কাজ করেছে- পার্শ্বিকতায় সরিয়ে রাখা ইতিহাসের উদ্ধার।
দ্বিতীয় ধারা- যে ধারাটি তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানের বহু বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই লক্ষ করা যায়- সেটি হল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় সন্ধান। তা কি ধর্মের দ্বারা চিহ্নিত হবে? নাকি এক উদার, বহুমাত্রিক বাঙালির অসাম্প্রদায়িক পরিচয় তৈরি হবে? বলা বাহুল্য, তার উত্তর দ্বিতীয় বিকল্পকেই গ্রহণ করেছে। তার ‘স্বরূপের সন্ধানে’ (১৯৭৬), ইংরেজি Creativity,
Identity and Reality (1991), Cultural Pluralism (1993), Identity, Religion and Recent History
(1995) ইত্যাদি বই সেই উদ্বেগ আর আগ্রহের প্রমাণ। তৃতীয় ধারা- অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের দুর্মূল্য নথিপত্রের আবিষ্কার ও উদ্ধার- লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে তিনি যেগুলো পেয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ (১৯৮৩), ‘পুরানো বাংলা গদ্য’ (১৯৮৪) এবং ইংরেজি Factory Correspondence and Other Bengali Documents in the India Office Library Records (1983). আর চতুর্থত, তার আত্মজীবনীমূলক নানা লেখা, যার প্রসন্ন গদ্য যেমন আমাদের আকর্ষণ করে তেমনি তার অভিজ্ঞতার বিস্তার আমাদের অভিভূত করে। এ বইগুলোর মধ্যে আছে ‘আমার একাত্তর’ (১৯৯৭), ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর’ (১৯৯৮), ‘কাল নিরবধি’ (২০০৩) ইত্যাদি।
এ অসাধারণ জ্ঞানতাপস আর মহৎ মানুষটির জন্য জাতীয় বা বাংলাবিদ্যার পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক শোক নিশ্চয়ই পালিত হবে। কিন্তু আমরা যারা তার ব্যক্তিগত স্নেহ পেয়েছি, তাদের কাছে যে বিপুল শূন্যতা তৈরি হল তার সান্ত্বনা কোথায়? আমাদের এ বয়সে স্নেহ পাওয়ার উৎস খুব বহুলসংখ্যক থাকে না। তাও যখন একে একে বিলুপ্ত হয় তখন আমাদের নিজস্ব শোকও অসহনীয় হয়ে ওঠে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা