Our Concern
Ruposhi Bangla
Hindusthan Surkhiyan
Radio Bangla FM
Third Eye Production
Anuswar Publication
Ruposhi Bangla Entertainment Limited
Shah Foundation
Street Children Foundation
November 21, 2024
হেডলাইন
Homeসাহিত্যগল্পইভ’স ডায়েরি

ইভ’স ডায়েরি

ইভ’স ডায়েরি

ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন


মার্ক টোয়েন

অনুবাদ: জাহানারা দোলন

[‘ইভ’স ডায়রি’ (১৯০৬) টোয়েনের সেরা গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানে টোয়েন, তাঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ জ্ঞান এবং স্যাটায়ারের মাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্যের মূল সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন। এই গল্পে ‘অ্যাডাম’স ডায়রি’র নির্যাস বা সারমর্মটা পাওয়া যায়। যা কিনা, একটি অনির্ভরযোগ্য কল্পনার মধ্যে মোটামুটি নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণ।]


শনিবার: আজ, এখন, পৃথিবীতে আমার বয়স মাত্র একদিন। মাত্র গতকালই আমি এখানে এসেছি। আমার কাছে এরকমই মনে হচ্ছে। অবশ্য, গতকালের আগেই আমাকে এখানে আনা হয়েছে কিনা জানি না। এমনটা হলে নিশ্চয়ই আমার মনে পড়ত। তাছাড়া, এই পৃথিবীটাও এখানে ছিল কিনা সেটাও আমি জানিনা, জানার কোনও উপায়ও নেই। অবশ্য এমনটাও হতে পারে যে যখন (যদি এটা গত পরশুদিনের ঘটনা হয়ে থাকে), ঘটনাগুলো ঘটছিল অর্থাৎ, আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এসে এখানে রাখা হচ্ছিল, আমার আশেপাশের সবকিছু ঠিকঠাক করা হচ্ছিল, হয়ত আমার সামনেই সবকিছু ঘটছিল এবং আমি খেয়াল করছিলাম না অথবা অচেতন ছিলাম।

খুব ভালো। এখন থেকে আমি খুবই সচেতন থাকব। আবার যদি গত পরশুদিনের মতো কোনও ঘটনা ঘটতে শুরু করে তবে আমি সেটাকে লিখে রাখব। লিখে রাখার ব্যাপারটা বোধহয় এখন থেকেই শুরু করা উচিত যেন তথ্যে কোথাও কিছু সন্দেহ না থেকে যায়। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই বিবরণগুলো ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

আমার এখন নিজেকে একটা গিনিপিগের মতো মনে হচ্ছে , যেন একটা গবেষণার বস্তু মতো অনুভূতি। আমার পরিস্থিতিতে পড়লে যে কেউই এটা ভাবতে বাধ্য হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে না পড়লে এই অনুভূতির অনুভব করা অসম্ভব। সুতরাং আমার নিজেকে এভাবেই আশ্বস্ত করতে হলো যে, আমি সেটাই -একটা পরীক্ষা, স্রেফ একটা পরীক্ষা মাত্র। আর কিছুই না।

কিন্তু এটা যদি একটা পরীক্ষণই হয়ে থাকে, শুধু আমাকে দিয়েই কী সমস্ত পরীক্ষাটা চলছে? না, আমার তা মনে হয় না। আমার মনেহয়, আমি এই নিরীক্ষার মূল বিষয়বস্তু হলেও অবশিষ্ট বিষয়বস্তুটাও এই পরীক্ষায় তার নিজস্ব ভূমিকা ঠিকই পালন করবে। আমার কাজ এখানে শুধু এটাই, নাকি আমাকে এখানকার সবকিছুর দেখাশোনাও করতে হবে বিষয়টা পরিষ্কার নয়। সমস্যা নেই, পরে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, ‘কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরী।’ (আমার মনে হয়, একজন অল্প বয়সী মেয়ে হিসেবে এটা বেশ ভারী একটা বাক্য।)

গত দিনের তুলনায় আজ চারপাশটা দেখতে মোটামুটি স্বাভাবিক লাগছে। আসলে শেষ করবার তাড়াহুড়োতে পাহাড়গুলোকে গতকাল কর্কশ এবড়োখেবড়ো অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল এবং বেশ কিছু সমতলভূমিতে আবর্জনা আর শেষাংশ একেবারে বিরক্তিকর তালগোল পাকিয়ে ছিল। শিল্পের শ্রেষ্ঠ, সুচারু কাজে তাড়াহুড়ো করা ঠিক না। এই আশ্চর্যজনক নতুন বিশ্বটি নিঃসন্দেহে একটা মহান এবং সুন্দর শিল্প। এবং এটা সময়ের স্বল্পতা সত্ত্বেও অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে প্রায় নিখুঁতের কাছাকাছি। আকাশের কিছু জায়গায় একসঙ্গে অনেকগুলো নক্ষত্র রয়েছে, আবার অন্য জায়গায় রয়েছে অনেক কম। অবশ্য এইসব অব্যবস্থাপনাগুলো এখনো ঠিকঠাক করে দেওয়া যায়। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

গতরাতে চাঁদটা হঠাৎ আলগা হয়ে খসে পড়ে গেল। একেবারে পৃথিবীর বাইরে – কী অপূরণীয় ক্ষতি! মনে পড়লেই আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। অলঙ্কার বা সাজানোর জিনিসগুলোর মধ্যে চাঁদের সঙ্গে তুলনা করার মতো এত্ত সুন্দর, সম্পূর্ণ আর একটাও নেই। চাঁদটা আরও ভালো করে বেঁধে রাখা উচিত ছিল। ইশ্, এটাকে যদি আবার কখনও কোনোভাবে ফিরে পাই!  তখন অবশ্যই এটি কোথায় কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল তা নিয়ে কোনো কথা হবে না। তাছাড়া, যে-ই এটাকে পাবে, সে-ই এটাকে লুকিয়ে রাখবে। আমি জানি, কারণ আমি নিজে হলেও এটাই করতাম।

আমার ধারণা, আমি অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে সৎ থাকতে পারি। কিন্তু আমি ইতোমধ্যে বুঝতে শুরু করেছি যে আমার স্বভাবের গভীরতম ধরণের মূলকেন্দ্রটি হলো সুন্দরের প্রতি ভালোবাসা, সুন্দরের প্রতি আবেগ। এবং আমাকে একমাত্র চাঁদটা নিয়ে বিশ্বাস করা আদৌ ঠিক হবে না যেটা এখন আরেকজনের কাছে রয়েছে এবং ওই ব্যক্তি জানতেন না যে ওটা একসময়ে আমার ছিল। আমি দিনের বেলা চাঁদটা পেলে ছেড়ে দিলেও দিতে পারি, কারো দেখে ফেলার ভয়ে; কিন্তু রাতের বেলা হলে, আমি নিশ্চিত আমি এটা নিয়ে কোনো কথাই বলব না। আমি চাঁদগুলো ভীষণ ভালোবাসি, কারণ এগুলো খুব সুন্দর এবং রোমান্টিক। আমাদের যদি পাঁচটা বা ছয়টা চাঁদ থাকত; আমি কখনোই বিছানায় যেতাম না; শ্যাওলা-তীরে শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমি কখনোই ক্লান্ত হতাম না।

নক্ষত্রগুলোও অনেক ভালো। এর কয়েকটা যদি চুলে সাজানোর জন্য পেতাম! আমার মনে হয় সেটা কখনোই পাওয়া যাবে না। নক্ষত্রগুলো যে কতটা দূরে তা জানতে পারলে অবাক হয়ে যেতে হয়, কারণ এই দূরত্বটা আন্দাজ করা যায় না। ওগুলো যখন প্রথম দেখা গিয়েছিল, গত রাতে, আমি ওদের কয়েকটাকে পেড়ে ফেলার জন্য একটি লম্বা লাঠি দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এটি পৌঁছয় নি। আমি অবাক হয়ে গেলাম; তারপরে আমি মেঘগুলো নিয়ে চেষ্টা করলাম একেবারে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু একটাও পাড়তে পারলাম না। কারণটা হয়ত আমি বাঁহাতি এবং ভালো ছুঁড়তে পারি না।

আমি যেটাকে চেয়েছি সেটাকে পেড়ে ফেলতে না পেরে যেটাকে চাই নি সেটার দিকে লক্ষ্য তাক করলাম। এবং আমি কিন্তু লক্ষ্যভেদের প্রায় কাছাকাছিই ছিলাম, কারণ, চেষ্টাটা ছেড়ে দিতেই, মেঘের সোনালি আভার ভেতরে একটা কালচে দাগ দেখতে পেলাম চল্লিশ বা পঞ্চাশবার। আমি যদি আরও কিছুটা সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতাম তাহলে হয়ত আমি এর একটাকে পেয়েই যেতাম।

আমি একটুখানি কান্না করলাম, আমার এই বয়সে এটাই স্বাভাবিক। পরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে একটা ঝুড়ি নিয়ে রওনা করলাম। উদ্দেশ্য, বৃত্তাকার সমতলভূমির শেষ প্রান্ত, যেখানে নক্ষত্রগুলো মাটির এতটা কাছে আছে যে, আমি ওগুলোকে হাত দিয়েই পেড়ে নিতে পারব। এটাই ভালো, কারণ আমি তখন ওগুলোকে ঝামেলাহীনভাবে ভেঙে ফেলা ছাড়াই সংগ্রহ করতে পারব।

কিন্তু আসলে প্রান্তের দূরত্বটা আমার কল্পনার থেকে এত এত বেশী যে শেষমেশ আমি হাল ছেড়ে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, আর এক পা হাঁটার জন্য পা টাকে টেনে তোলার ক্ষমতা ছিল না আমার। পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল এবং সেগুলো ফেটে গিয়ে ভীষণ যন্ত্রণা করছিল। সে রাতে আমি আমার থাকার জায়গাটাতে ফিরতে পারলাম না। জায়গাটা এখান থেকে অনেক অনেক দূরে আর বেশ শীত পড়ে গিয়েছিল। আমি সেখানে কিছু বাঘের আস্তানা খুঁজে পেলাম যেগুলো বেশ প্রশংসাসূচকভাবে আরামদায়ক। বাঘগুলোর প্রশ্বাসের গন্ধ ছিল মিষ্টি সুঘ্রানযুক্ত। কারণ ওরা স্ট্রবেরি খায়। আমি এর আগে কখনো বাঘ দেখি নি। কিন্তু আমি ওদের গায়ে ডোরাকাটা দাগ দেখামাত্র জেনে গিয়েছিলাম যে, ওগুলো বাঘ। আমি যদি ওদের চমৎকার চামড়ার মাত্র একটাও পেতাম, একটা দারুণ গাউন তৈরি করতে পারতাম।

গতকালের তুলনায় আজ আমার মধ্যে দূরত্ব সম্পর্কে খানিকটা ধারণা তৈরি হয়েছে। যে কোনো সুন্দর কিছু দেখলেই সেটা আমার এমনভাবে পেতে ইচ্ছে করে যে, আমি ওটা পাওয়ার জন্য ছুটে যাই। কখনো সেগুলো থাকে নাগালের বাইরে, আবার কখনো হাতের নাগালের মধ্যেই- কিন্তু, হায়! মাঝখানে কাঁটা। আমি একটা শিক্ষা পেলাম। পাশাপাশি, একটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য তৈরি করলাম, পুরোটাই নিজের মাথা থেকে – আমার সর্বপ্রথম। কাঁটা ধরলে খোঁচা খেতে হয়। আমার মনে হয়, এত অল্পবয়সী একজনের জন্য এটা একটা বিশাল ব্যাপার।

আমি আমার মতো অন্য পরীক্ষাটিকে কাছাকাছিই লক্ষ্য করলাম। গতকাল বিকেলের দিকে একটু দূর থেকে আমি ওটাকে দেখছিলাম, আসলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে ওটাকে ঠিক কিসের জন্য এখানে রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না।

আমার ধারণা, ওটা একটা পুরুষ। আমি এর আগে কখনো পুরুষ দেখি নি কিন্তু ওটাকে সে রকমই দেখাচ্ছে। এবং আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি যে, ওটা আমি যা ভাবছি ঠিক তাই। আমি টের পাচ্ছি যে, আমি ওটার বিষয়ে অন্য সরীসৃপগুলো থেকে একটু বেশীই কৌতুহল অনুভব করছি। যদি ওটা সরীসৃপ হয়, আমার ধারণা ওটা সরীসৃপই। কারণ ওটার চুলগুলো ঝাঁকড়া আর চোখের রঙ নীল। চাউনিটা একেবারেই সরীসৃপের মতো। ওটার কোনো নিতম্ব নেই, এবং পানির নলটা গাজরের মতো দেখতে। সেটা যখন দাঁড়ায়, ভারী কিছু তোলার মতো নিজে থেকেই উঠতে শুরু করে তারপর নিজের থেকে দূরে ছড়িয়ে দেয়। সুতরাং আমার হিসেবে ওটা সরীসৃপ, অবশ্য একটা স্থাপত্য কর্মও হতে পারে।

প্রথম প্রথম আমি ওটাকে বেশ ভয় পেতাম, ওটাকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখলেই দৌড়ে পালাতাম। ভাবতাম, ওটা আমাকে ধাওয়া করবে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, ওটা নিজেই আমার থেকে দূরে থাকবার চেষ্টা করছে। এটা বুঝতে পারার পর আমি আর আদৌ শান্ত থাকলাম না, বরং ওটাকে অনুসরণ করতে লাগলাম, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে, বিশ কদম দূর থেকে। যা তার স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে অসুখী করে তুলল। শেষ পর্যন্ত সে ভীষণরকম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, একটা গাছে গিয়ে চড়ে বসল। আমি বেশ খানিকটা অপেক্ষা করে তারপর হাল ছেড়ে দিলাম এবং বাড়িতে ফিরে এলাম।

আজকেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল এবং ওটা আবারো গিয়ে গাছে চড়ে বসল।

 

রোববার: ওটা এখনো ওই ওপরে, গাছে উঠে চড়ে বসে আছে। বিশ্রাম নিচ্ছে বলে ভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু আসল বিষয়টা হচ্ছে এটা আমাকে এড়ানোর একটা কৌশল। রোববার বিশ্রাম করবার দিন নয়। বিশ্রামের জন্য শনিবারকে রাখা হয়েছে। এটাকে আমার এমন একটা প্রাণী বলে মনে হচ্ছে, যেটা শুধুমাত্র ঝিমাতে পছন্দ করে।

শুধু শুধু বসে বসে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগছে যে, ওটাকে ঠিক কিসের জন্য এখানে আনা হয়েছে। আমি এটাকে কখনোই কিছু করতে দেখি না।

কারা যেন গতরাতে চাঁদটাকে ফেরত দিয়ে গেছে, আমার যে কী ভীষণ আনন্দ লাগছে! এটা সত্যিকার অর্থেই একটা মহানুভবতাপূর্ণ কাজ। চাঁদটা আবারো খসে পড়ে গেল, কিন্তু আমি আর দুঃখ পেলাম না। এমন দয়ালু প্রতিবেশী থাকতে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। তারা ঠিকই ওটাকে কুড়িয়ে পেয়ে আবার ফেরত দিয়ে যাবে। ইশ! আমি যদি আমার কৃতজ্ঞতা বোঝাতে তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারতাম! আমি তাদের কিছু নক্ষত্র উপহার দিতে পারি, কারণ ওগুলো আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আছে।

ইয়ে..মানে..শব্দটা ‘আমার’ হবে, ‘আমাদের’ নয়, কারণ ওই সরীসৃপটার এসব বিষয় নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। ওটার রুচি অত্যন্ত নিম্নমানের এবং এর ভেতরে কোনও দয়ামায়া নেই। গতকাল গোধূলিবেলায় যখন আমি ওটার ওখানে গেলাম, দেখি সেটা বাঁকা হয়ে নিচে পানিতে খেলতে থাকা সুন্দর দাগওয়ালা ছোট্ট মাছগুলোকে ধরার চেষ্টা করছে। মাছগুলোকে নিরিবিলিতে থাকতে দেওয়ার জন্য সরীসৃপটাকে ঢিল ছুঁড়ে আবার গাছে তুলে দেওয়া ছাড়া আমার আর উপায় থাকল না।

আমি অবাক হয়ে যাই, ওটাকে ঠিক কিসের জন্য এখানে আনা হয়েছে। এর কী হৃদয় বলতে কিছু নেই? ওই সুন্দর তুলতুলে জীবগুলোর জন্য এটার কী কোনো মায়া হয় না? এও কী সম্ভব, যে এ জাতীয় অভদ্র কর্মকাণ্ড করার জন্যই ওটাকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে? আমার সে রকমই মনে হচ্ছে। আমার ছুঁড়ে দেওয়া ঢিলের একটা গিয়ে ওটার কানে লাগল আর অমনি সেটা ব্যথায় আওয়াজ করে উঠল। আমি শিহরিত হলাম। এই প্রথম আমি আমার নিজের ছাড়া অন্য কারো কথা শুনলাম। শব্দগুলো বুঝলাম না কিছুই, কিন্তু অর্থবহ বলে মনে হচ্ছিল।

যখন আমি আবিষ্কার করলাম যে ওটা কথা বলতে পারে, আমি নতুন করে ওটার বিষয়ে আগ্রহবোধ করলাম। কথা বলতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। প্রায় সারাদিনই আমি কথা বলি, এমনকি ঘুমের ভেতরেও। আমি কথা বলতে খুবই আগ্রহী আর যদি কথা বলার মতো আরেকজন কাউকে পাওয়া যায় তাহলে আগ্রহ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। কথা বলা কখনোই থামবে না। অবশ্য, বলার গরজ থাকলে।

এখন, এই সরীসৃপটা যদি একজন পুরুষ হয় তাহলে তার সম্পর্কে বলতে হলে অবশ্যই ‘ওটা’ বলা যাবে না, তাই না? সেটা আসলে ঠিক ব্যাকরণ সম্মত দেখায় না। আমার মনে হয় ওটাকে ‘সে’ বলা উচিত। এভাবে, তার বিষয়ে শব্দগুলো হবে -সে, তাকে, তার। ঠিক আছে, আমি তাকে একজন পুরুষ মনে করে এভাবেই বলতে থাকব, যদি না সে অন্য কোনো প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটা অনেক অনাকাঙিক্ষত ঝামেলা সামলানোর থেকে সহজ।

পরের সপ্তাহের রবিবার: সারাটা সপ্তাহ আমি তার সঙ্গে সেঁটে রইলাম পরিচিত হওয়ার জন্য। কথা বলার কাজটা মূলত আমাকেই করতে হচ্ছিল। সে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি তাতে কিছু মনে করি নি। আমাকে পেয়ে তাকে বেশ খুশি মনে হচ্ছিল। তার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি বারবার ‘আমাদের’ শব্দটা ব্যবহার করছিলাম। আর সবকিছুতে নিজেকেও সম্পৃক্ত ভাবতে পেরে সে অভিভূত ছিল।

 

বুধবার: এখন পর্যন্ত আমরা বেশ ভালোই আছি এবং ধীরে ধীরে পরিচয়টা বেশ এগোচ্ছে। এখন আর সে আমাকে এড়িয়ে যেতে চায় না, এটা একটা ভালো লক্ষণ। এতে এটা বোঝা যায় যে আমাকে সঙ্গে পেয়ে তার ভালো লাগছে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়েছে । আমি তার প্রতিটা কাজে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তার কাজের বিষয়ে ধারণা নিতে শুরু করলাম।

গতকাল অথবা এর দুদিন আগে পর্যন্ত আমি তার সমস্ত কাজ এবং কাজ সম্পর্কিত সবকিছুর নামকরণ করে দিলাম। এটা তার জন্য ভীষণরকম স্বস্তিদায়ক হলো।

কেননা, কোনো কিছুর নামকরণ করার বিষয়ে তার কোনও প্রতিভা নেই। এবং সে স্বভাবতই বেশ কৃতজ্ঞ মনোভাব প্রদর্শন করল। সে ভাবতেই পারে নি, সাধারণ কিছু নামকরণের মাধ্যমে তার কাজ এতটা ঝামেলা মুক্ত হয়ে যেতে পারে। তার এই ঘাটতির ব্যাপারটা যে আমি জেনে গেছি সেটা আমি তাকে বুঝতে দিলাম না।

যখনই কোনো একটা নতুন জীবজন্তু দেখতে পাই, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওটার একটা নাম দিয়ে দেই যেন সে চুপচাপ হয়ে গিয়ে নিজের অপ্রস্তুত অবস্থা প্রকাশ করার সময় না পায়। এভাবে আমি তাকে অনেক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়া থেকে বাঁচিয়ে দেই। আমার এ বিষয়ে কোনো সমস্যা হয় না। কোনো একটা প্রাণী চোখে পড়া মাত্র আমি জেনে যাই ওটা কী। এক মুহূর্ত অপেক্ষা ছাড়াই। এর সঠিক নাম পরিচয় সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরে এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে যেন এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অথচ আমি নিশ্চিত, প্রাণীটিকে দেখার আধমিনিট আগেও এর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কীভাবে যেন, প্রাণীটির শারীরিক গঠন এবং আচরণ দেখামাত্রই আমি জেনে যাই এর পরিচয়।

ডোডো পাখিটাকে সে একটা জংলী বিড়াল মনে করল- তার চোখ দেখেই আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে এই লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে দিলাম। সতর্কভাবে, যেন তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত না পায়। সাধারণ কথা বলার ছলে, তাকে যে তথ্য সরবরাহ করছি এটা বুঝতে না দিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, মেনে নিচ্ছি, ওখানে যদি ওই ডোডো পাখিটা না থাকত!’ -বুঝিয়ে দিলাম, আমি যে বুঝিয়ে দিচ্ছি, সেটা বুঝতে না দিয়ে।

-এটা যে ডোডো পাখি সেটা আমি কেমন করে জানলাম, সে জানে না অথচ আমি দিব্বি জেনে বসে আছি
কোন্‌টা কোন্‌ প্রাণী এটা নিয়ে তাকে খানিকটা গর্বিত মনে হলো এবং তার প্রশংসা বাক্যে সেটা নিশ্চিত হওয়া গেল। ব্যাপারটা গ্রহণযোগ্য। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি সেটা কয়েকবার ভাবলাম। ভাবনাটা আনন্দদায়ক। কত ছোট্ট ছোট্ট বিষয় আমাদের আনন্দিত করতে পারে, যখন আনন্দটুকু অর্জন করে নেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার: আমার প্রথম দুঃখ। গতকাল সে আমাকে এড়িয়ে গেছে, এমন একটা ভাব করেছে যেন সে চায় না আমি আর তার সঙ্গে কথা বলি। আমি এটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়েছে। যার সঙ্গে থাকতে, কথা বলতে আমি এত ভালোবাসি সে কী করে আমার প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারে? তার এ ধরণের আচরণ পাওয়ার মতো কোনো কাজই আমি করি নি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কিছু ভুল হয় নি, এটাই সত্য।

আমি ফিরে এলাম। পৃথিবীতে আমাদেরকে তৈরি করার পরের প্রথম সকালে যেখান থেকে আমি তাকে প্রথম দেখেছিলাম সেখানে একলা বসে রইলাম। তখন আমি তাকে জানতাম না, অন্যদের থেকে তার ভিন্নতাকে বুঝতাম না। অথচ এখন সেই প্রথম দেখার জায়গাটা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, প্রতিটা জিনিস শুধু যেন তার কথাই বলছে, আর আমার হৃদয় হাহাকার করছে। কেন, কী জন্যে, তার কিছুই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলাম না কারণ এটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতি। যা এর আগে কখনোই অনুভব করি নি। কেমন যেন ধোঁয়াশাপূর্ণ রহস্যের আবরণে ঘেরা সেই অনুভূতি। যে রহস্য আমি ভেদ করতে পারছিলাম না।

যখন রাত নামল, আমি আর এই নিঃসঙ্গতাকে সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি উঠে তার কুটিরে গেলাম। জানার জন্য, আমার ভুলটা কোথায় ছিল, ঠিক কী করলে সেটাকে ঠিক করা যাবে, আগের মতো। কিন্তু সে আমাকে কুটিরে ঢুকতেই দিল না, অঝোর বৃষ্টি ঝরা রাতে সে আমাকে বাইরে রেখে দিল, এটা ছিল আমার প্রথম দুঃখ।

রোববার: আমাদের সুখের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে, আমি সুখী। কিন্তু দুঃখের ওই দিনগুলো ছিল প্রচন্ড ভারী। পারতপক্ষে আমি ওসব দিনের কথা মনেও করতে চাই না।

আমি তাকে ওই আপেলগুলোর কয়েকটা দিতে চাইলাম কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি সোজাসুজি ছুঁড়ে দেওয়াটা শিখে উঠতে পারি নি। আপেলগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো, কিন্তু আমার ইচ্ছেটা বুঝতে পেরে তাকে খুশি মনে হলো। ওগুলো নিষিদ্ধ, সে বলল আমি তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলতে পারি।

আমি যদি ক্ষতি করেও তাকে আনন্দ দিতে পারি, তাহলে ওই ক্ষতির পরোয়া কে করে?

সোমবার: আজ সকালে ওকে আমার নাম বললাম। ভেবেছিলাম তার ভালো লাগবে। ওর যেন এটা গায়েই লাগল না। আশ্চর্য! ও যদি আমাকে ওর নামটা বলত, আমার ভালো লাগত। যে কোনো শব্দের থেকে ওর নামটা আমার কর্ণকুহরে বেশী শ্রুতিমধুর হতো।

ও একেবারেই কম কথা বলে। হতে পারে এ বিষয়ে তার যথেষ্ট মেধা নেই তাই এটা নিয়ে তার ভিন্ন ধরনের সংবেদনশীলতা কাজ করে। সেটা গোপন করতেই হয়ত তার এ চেষ্টা। সে কেন যে এমনটা ভাবে! মেধা মূলত কিচ্ছু না। হৃদয়ই আসল প্রকোষ্ঠ যেখানে বোধের আবাস। ওকে যদি এটা বোঝাতে পারতাম যে, ভালোবাসা পূর্ণ একটা মনের মতো সম্পদশালী আর কিছুই হতে পারে না! ভালোবাসাহীন হৃদয় ছাড়া যে বুদ্ধিমত্তা, তার থেকে দৈন্যদশা আর হয় না।

যদিও সে কম কথা বলে, তার শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট পরিপূর্ণ। আজ সকালে কথা বলতে গিয়ে সে একটা বিস্ময়কর ভালো শব্দ ব্যবহার করল। সে নিঃসন্দেহে নিজেই বুঝতে পেরেছে যে কাজটা ভালো ছিল। এজন্য সে পরবর্তীতে আরো দু বার কাজটা করল, প্রতিদিনের মতো করে। এটা একটা নৈমিত্তিক শিল্পকর্ম। অবশ্য এ কারণেই তার উপলব্ধি যে বেশ উঁচুদরের সেটা বোঝা গেল। যে কোনো বীজ থেকেই উদ্ভিদ হয়, যদি তাকে চাষ করা হয়।

সে কোত্থেকে এই শব্দটা পেল? আমি তো কখনো এই শব্দ ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়ে না!

নাহ্, আমার নাম নিয়ে তার কোনো কৌতুহল নেই। আমি আমার নিরাশা লুকানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সম্ভবত আমি সফলতা লাভ করতে পারি নি।

আমি দূরে সরে গেলাম, পানিতে পা ভিজিয়ে শ্যাওলা তীরে এসে বসলাম। যখন ভেতরটা কারো সঙ্গলাভের জন্য বুভুক্ষু হয়ে ওঠে, চায় কেউ সেটা দেখুক,কিছু একটা বলুক তখন আমি এখানটাতে এসে বসি। তখন পানিতে আঁকা সুন্দর সাদা শরীরের মেয়েটা আসে। আমার তাতে মন ভরে না। কিন্তু, অখণ্ড একাকীত্বের থেকে তো ভালো! আমি কথা বললে পানির মেয়েটাও কথা বলে, আমি দুঃখ পেলে, ওকেও দুঃখ ভারাক্রান্ত লাগে। ওর সমবেদনায় আমি স্বস্তি পাই। সে আমাকে বলে, ‘মন খারাপ করতে নেই একলা মেয়েটা, আমি তোমার বন্ধু হবো।’ ও আমার একজন ভালো বন্ধু, একমাত্র বন্ধু। ও আমার বোন।

যেদিন প্রথম ও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আহ্! আমি সেদিনের কথা কোনদিনও ভুলতে পারব না, কক্ষনো পারব না, কোনদিনও না। আমার হৃদপিন্ডটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। ‘একমাত্র সেই ছিল, এখন সেও চলে গেল!’ মনে মনে বলতে থাকলাম, ‘হৃদয় তুমি শেষ হয়ে যাও, এ জীবন আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’ আমার জন্য কোথাও কোনো সান্ত্বনা অবশিষ্ট রইল না। আমি দু হাতে মুখটা ঢেকে ফেললাম। খানিক পরে হাত সরাতেই দেখি আবার সে ফিরে এসেছে। ফর্সা, উজ্জ্বল, সুন্দর মেয়েটা। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর দুই বাহুর মধ্যে।

সেটা ছিল পরিপূর্ণ আনন্দ। আনন্দের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, কিন্তু এটা ভিন্ন ধরনের সুখ। এটাই পরমানন্দ। এরপরে আর তাকে নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। কখনো কখনো সে দূরে থাকে – ঘন্টাখানেক, হয়তবা সমস্ত দিনই। আমি অপেক্ষা করতাম, সন্দেহ করতাম না। নিজেকে প্রবোধ দিতাম, ‘সে ব্যস্ত আছে, অথবা দূরে কোথাও গেছে, কিন্তু সে আসবেই।’ এবং এটাই ঘটত, সে ফিরে আসত। সবসময়।

অন্ধকার রাতে সে আসত না। সে তো শান্ত ছোট্ট একটা মেয়ে। কিন্তু চাঁদ উঠলে সে আসত। আমার অন্ধকারে ভয় লাগে না, কিন্তু ও তো আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমার পরে ওর জন্ম। আমি বারবার ওর কাছে ছুটে যাই। আমার কঠিন সময়গুলোর একমাত্র আশ্রয়স্থল। এ কারণেই ওর কাছে আমার যাওয়া।

 

মঙ্গলবার: সমস্ত সকালটা জমিজমার কাজ করে কাটিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখলাম যেন সে নিঃসঙ্গবোধ করে এবং আমার কাছে ফিরে আসে। কিন্তু সে আসে নি।

দুপুরের দিকে আমি কাজে ক্ষান্ত দিলাম এবং আমার মন ভালো করার জন্য মৌমাছি আর প্রজাপতিদের উড়িয়ে দিয়ে, ফুল নিয়ে মেতে থাকলাম। এইসব সুন্দর সৃষ্টিগুলো আকাশ থেকে ঈশ্বরের হাসি পৃথিবীতে বয়ে নিয়ে আসে। আমি সমস্ত ফুল জড়ো করে তোড়া তৈরি করলাম, মালা গাঁথলাম। আমার দুপুরের খাবার– অবশ্যই আপেল, খেতে খেতে নিজেকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুললাম। তারপর ছায়ায় বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চেয়েছিলাম সে আসুক। কিন্তু, সে আসে নি।

এগুলো কিছুই না। এগুলোর থেকে কিছু ফল পাওয়া সম্ভব না কারণ, তার কাছে ফুলের কোনো মূল্য নেই। সে ফুলগুলোকে বলে আবর্জনা। তার কাছে সব ফুল একই রকম। এবং মনে করে এরকম করলেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। তার কাছে আমার কোনো মূল্য নেই, ফুলের কিংবা রঙিন গোধূলি আকাশের কোনো মূল্য নেই– তার কাছে মূলত নির্মল বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে খুপড়ি সদৃশ ঝুপড়ি তৈরি করে তার মধ্যে বসে থাকা কিংবা তরমুজের বিশালতা পরিমাপ অথবা আঙুরের মান পরিমাপ করা আর গাছে থাকা ফলগুলোকে গুঁতিয়ে ফসল তোলার সময় হিসেব করা ছাড়া আর কিসের দাম আছে ?

আমি মাটিতে একটা শুকনো কাঠি রেখে ওটাকে আরেকটা শুকনো কাঠি দিয়ে ছিদ্র করার চেষ্টা করছিলাম। কিছু একটা করতে হয় বলে করছিলাম আর কি, এমন সময় হঠাৎ করেই এক অভূতপূর্ব ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে পেলাম। একটা সরু নীলচে গোলাপী আভা কাঠের ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসছিল। আমি সবকিছু ফেলে ঝেড়ে দৌড় লাগালাম। আমি ওটাকে আত্মা মনে করে এত্ত ভয় পেয়েছিলাম না! কিন্তু যখন ঘুরে তাকালাম, দেখলাম যে ওটা আমার পেছনে ধাওয়া করে নি। তো, আমি একটা পাথরের আড়ালে গিয়ে হাঁপানি থামাতে একটু জিরিয়ে নিলাম। শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে কাঁপুনি থামিয়ে স্বাভাবিক হতে দিলাম।

কিছু পরে খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখে, হামাগুড়ি দিয়ে ফিরতে শুরু করলাম। অবশ্য, দরকার পড়লেই ঝেড়ে দৌড় লাগানোর প্রস্তুতি নিয়ে। এরপর বেশ কাছাকাছি এগিয়ে গোলাপঝাড়ের পেছনে গিয়ে বসলাম। ঝাড়ের ডালগুলো দুদিকে সরিয়ে মাঝখান থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম, আশা করছিলাম লোকটা আমাকে দেখুক, ওদিকটা থেকে আমাকে দেখতে কতটা চাতুর্যপূর্ণ আর সুন্দর লাগছে! 

ভুতটা চলে গেছে। আমি জায়গাটাতে ফিরে এলাম। দেখলাম কাঠের গর্তে খানিকটা কোমল গোলাপী ধুলো পড়ে আছে। ওটাকে অনুভব করার জন্য ওখানে আঙুল রাখলাম, উফ্ ! সঙ্গে সঙ্গে আঙুলটা বের করে আনলাম। এটা ছিল একটা তীব্র নিষ্ঠুর ব্যথা। আমি আঙুলটা মুখে পুরলাম। ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে শরীরের ভর প্রথমে এক পায়ে রেখে পরে অন্য পায়ে চাপিয়ে, এভাবে করে আমি আমার ব্যথাকে সহ্য করে নিলাম।

এরপরে আমি পূর্ণ মাত্রায় কৌতূহলী হয়ে উঠলাম এবং পরীক্ষা করতে শুরু করলাম। আমি বুঝতে চাইছিলাম যে এই গোলাপী ধুলো আসলে ঠিক কী বস্তু। হঠাৎ করেই আমার মধ্যে এর নামটা চলে এল। এমন নাম আমি আগে কখনো শুনি নি। এটা ছিল ‘আগুন।’ পৃথিবীর যে কোনও মানুষের পক্ষে যতটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব, আমি ঠিক ততটাই নিশ্চিত ছিলাম। কোনোরকম ইতস্তত বোধ না করে আমি এর নামকরণ করলাম– আগুন।

আমি এমন একটা জিনিস তৈরি করলাম যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পৃথিবীর অগণিত সম্পদে একটা নতুন জিনিস যুক্ত করলাম, এই উপলব্ধির অনুভূতি আমাকে গর্বিত করে তুলল। আমার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে ঘটনাটা বলতে চাইলাম, — কিন্তু আমার মন আমাকে বারণ করল এবং আমি তার কাছে যাই নি। না, তার এতে কিছুই যাবে আসবে না। সে বরং প্রশ্ন করতে পারে যে ‘এটা দিয়ে কী হয়, তখন আমি এর কী জবাব দেব? যদি এটার আদৌ কোনো গুণাগুণ না থাকে, শুধুই দেখতে সুন্দর হয়, নিছক সুন্দর?

শেষমেশ আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, তার কাছে আর গেলাম না। কারণ এই আগুনের কোনো উপকারিতা নেই। এটা দিয়ে ঝুপড়ি তৈরি করা যায় না, এটা তরমুজের ফলন ভালো করতে পারবে না, দ্রুত ফসল তোলার মতো কিছু এটা দিয়ে সম্ভব না। এটা একটা অকেজো জিনিস। এটা একটা নির্বুদ্ধিতা এবং আত্মরম্ভিতা। সে এটাকে তাচ্ছিল্য করে যা খুশি তাই বলত। কিন্তু আমার কাছে এটা তুচ্ছ নয়। আমি বরং বলব, ‘হে আগুন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, হে সুন্দর গোলাপী জীব, যেহেতু তুমি সুন্দর –আমার জন্য এটাই যথেষ্ট!’

আমি ওগুলোকে জড়ো করে প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু থেমে গেলাম। আমার মাথায় আরেকটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বাক্য তৈরি হলো। এটাও যেহেতু প্রায় আগের বাক্যের মতোই তাই এটা আবার লেখা চুরি জাতীয় কিছু হয়ে যায় কিনা আমি সেটা নিয়ে খানিকটা চিন্তিত ছিলাম, আগুনে হাত দিলে, হাত পুড়ে যায়। 

আমি আবার ওগুলোকে জড়ো করলাম। বেশ খানিকটা আগুনের ধুলো জমিয়ে মুঠো ভরে ফেললাম শুকনো বাদামি ঘাসের ওপর। ইচ্ছে ছিল বাড়িতে নিয়ে রেখে দেব তাহলে এগুলো নিয়ে যখন খুশী তখন খেলা করা যাবে। কিন্তু প্রবল বেগে বাতাস এসে ধুলাগুলোকে ছড়িয়ে দিল। বাতাসের ধাক্কায় আগুনের ধুলোকণা আমার দিকে ছিটে আসল ভয়াবহভাবে। আমি হাত থেকে সব ফেলে দিয়ে দৌড় দিলাম। দৌড়ের মধ্যে পেছনে তাকিয়ে দেখি, নীলাভ আত্মা উঁচু হয়ে মেঘের মতো বিশাল আকৃতি ধারণ করে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি এর নাম মনে করলাম– ‘ধোঁয়া’- যদিও আমার শোনা শব্দ তালিকায় ধোঁয়া নামের কিছু কখনো ছিল না।

খুব তাড়াতাড়ি উজ্জ্বল হলুদ আর লাল রঙের ঢেউ ধোঁয়ার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, আমি এর নাম দিলাম ‘অগ্নিশিখা।’ হ্যাঁ, আমি সঠিক নামকরণই করেছি। যদিও এগুলো ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম অগ্নিশিখা। তারা গাছ বেয়ে উঠতে লাগল লাগল। তারপর অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে ভেতরে বাইরে সর্বত্র অতিকায় বিপুলতা নিয়ে নেচে নেচে উঠে ক্রমাগত বাড়তেই থাকল। আমি খুশিতে হাততালি দিয়ে নেচে উঠলাম। এটা এতটাই আশ্চর্য আর বিস্ময়কর রকমের অসাধারণ সুন্দর ছিল।

সে দৌড়াতে দৌড়াতে এল, তারপর এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। ধ্যাত, তার সরাসরি প্রশ্ন করার স্বভাবটা খুবই বিশ্রী। আমাকেই তার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, আমিই উত্তর দিয়েছিলাম। বললাম, এটা আগুন। এটা হয়ত তাকে বিরক্ত করতে পারে যে সবকিছু আমিই কেন জানব। আর তাকে সেটা আমাকে জিজ্ঞাসা করে কেন জেনে নিতে হবে। সেটা আমার দোষ নয়। আমার তাকে বিরক্ত করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছা নেই। একটুখানি থেমে সে জিজ্ঞেস করল,

‘এটা কীভাবে এল?’

আরেকটা সরাসরি প্রশ্ন, আর এর উত্তরটাও সরাসরি হতে হবে,

‘আমি তৈরি করেছি।’

আগুন জ্বলতে জ্বলতে এগিয়ে যেতে লাগল। সে তখন পুড়ে যাওয়া জায়গাটার কিনারে গিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,

‘এগুলো কী জিনিস?’

‘আগুনের কয়লা।’

সে একটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চাইল, কিন্তু ধরার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত বদলে ওটা হাত থেকে ফেলে দিল। তারপর চলে গেল। কোনো কিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই।

আমার আগ্রহ ছিল। ওই যে ছাইগুলো, ধূসর নরম কোমল আর দেখতে কত সুন্দর — দেখামাত্রই আমি ওগুলোর নাম পরিচয় জেনে গেছি। আর জ্বলন্ত অঙ্গারগুলো। হ্যাঁ, ওগুলোকেও জেনেছি। আমি পেড়ে রাখা আপেলগুলো পেয়ে কৃতজ্ঞবোধ করলাম। আমি যেহেতু তরুণ, আমার খাবারের রুচি তখন বেশ জোরালো। কিন্তু আমাকে হতাশ হতে হলো। আগুনে দেওয়া আপেলগুলো ফেটে খুলে গিয়ে নষ্ট হলো। বেশিরভাগই নষ্ট হলো, সবটা নয়। কাঁচা আপেলের তুলনায় এটা খেতে বেশ সুস্বাদু। আগুন সুন্দর। একদিন এটা কাজেও লাগবে, আমার ধারণা।

 

শুক্রবার: আমি তাকে আবার দেখতে পেলাম, এক মুহূর্তের জন্য, সোমবার সন্ধ্যায়, কিন্তু শুধুই একটা মূহুর্ত। আশা করেছিলাম সে জমিজমার উন্নয়নের চেষ্টার জন্য আমার প্রশংসা করবে। কঠোর পরিশ্রম করে বেশ ভালো উন্নতি করেছিলাম। কিন্তু তাকে সন্তুষ্ট করা গেল না। সে চলে গেল, আমাকে ফেলে রেখে। সে আরো একটা ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিল। আমি আবারও তাকে ঝর্ণার ওপাশে না যাওয়ার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলাম। কারণটা হলো, আগুন আমার মধ্যে একটা নতুন অনুভূতির জন্ম দিয়েছে- বেশ নতুন। -ভালোবাসা, কষ্ট বা আগে অন্য যে অনুভূতিগুলো আবিষ্কার করেছি, সবগুলো থেকে একেবারেই আলাদা এটা, – ভয়। এবং এটা জঘন্য। এটা যদি আমাকে কখনোই আবিষ্কার করতে না হতো! এটা আমার সময়গুলো অন্ধকার করে ফেলে, সব সুখ নষ্ট করে দেয়। আমাকে শিহরিত করে তোলে, ঝাঁকিয়ে কাঁপাতে থাকে। কিন্তু, আমি তাকে বোঝাতে পারি নি, সে এখনো জানে না ভয় কী জিনিস। সুতরাং সে আমাকে বুঝতেও পারবে না।

 

অ্যাডামের ডায়েরির সারমর্ম
হয়ত আমার এটা মনে রাখা উচিত যে সে খুবই ছোট, প্রায় বালিকা এবং সবকিছুর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা তার স্বভাব। সে পুরোটাই কৌতুহল, আগ্রহ এবং প্রাণচঞ্চলতা দিয়ে ভরপুর। পৃথিবীটা তার কাছে একটা জাদুমন্ত্র, একটা বিস্ময়, একটা রহস্য, একটা আনন্দযজ্ঞ। সে যখনই নতুন একটা ফুল খুঁজে পায়, সে আনন্দের তীব্রতায় বাকহারা হয়ে যায়। তাকে তখন অবশ্যই এটাকে লালন করতে হবে, এর যত্ন নিতে হবে, এর সুগন্ধ নিতে হবে এবং এর সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং সর্বোপরি এটার ওপরে একটা আদুরে নাম চাপিয়ে দিতে হবে। শুধু এটাই নয়, সে একটা রঙ-পাগল। বাদামি পাথর, হলদে বালি, ধূসর মস, সবুজ পাতা, নীল আকাশ; ভোরের মুক্তো, পাহাড়ের ওপরকার বেগুনাভ ছায়া, সূর্যাস্তের সময় ক্রিমসন সাগরে ভাসমান সোনালী দ্বীপগুলো, বিচ্ছিন্ন সারিবদ্ধ মেঘের মধ্য দিয়ে মলিন চাঁদের বয়ে চলা, ঝকমকে রত্নের মতো নক্ষত্রগুলোর জ্বলজ্বল করা – যতদূর দেখেছি, এগুলোর কোনটিরই কোনো বাস্তব মূল্য নেই। কিন্তু যেহেতু এগুলো রঙবেরঙের এবং মহিমান্বিত, তার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। সে তখন এসবের ভাবনাতেই ডুবে থাকে।

যদি সে কয়েকটা মিনিটের জন্য মুখ বন্ধ রেখে সুস্থে বসতে পারত, সেটা একটা দর্শনীয় বিষয় হতো। তখন মনে হয় তাকে দেখতে আমার ভালোই লাগত। আমি নিশ্চিত, আমার ভালো লাগবে কারণ, আমি লক্ষ্য করেছি সে বেশ প্রশংসনীয় ধরনের শান্ত একটা প্রাণী– চটপটে, হালকা গড়নের, সুবিন্যস্ত, গোলাকার, সুগঠিত, চটুল, কমনীয় এবং একবার যখন সে তার মার্বেল সাদা শরীর নিয়ে পাথরের ওপরে সূর্যস্নাত হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা কাত করে, হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে আকাশে পাখির ওড়াউড়ি দেখছিল, আমি আবিষ্কার করলাম, সে সুন্দর।

 

সোমবার দুপুর: আমার জানা মতে, এই গ্রহে এমন কিছু নেই যেটাতে তার আগ্রহ নেই। যেখানে যত রকমের যত জীবজন্তু আছে, সবগুলোর মধ্যে আমি তো কোনো পার্থক্য দেখতে পাই না, কিন্তু সে পায়। তার কাছে কোনো বাছবিচার নেই, সে সবগুলোই গ্রহণ করবে, তার মতে এরা সব অমূল্য সম্পদ, যে কোনো নতুনকেই সে স্বাগত জানায়।

যখন বিশালদেহী ব্রনটোসরাসটা (তৃণভোজী ডায়নোসর) তার লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁবুতে চলে এল, সে এটাকে অর্জন হিসেবে দেখল, আর আমি দেখলাম একটা উপদ্রব। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাদৃশ্যের যে ঘাটতি এটা তার একটা ভালো উদাহরণ। সে এটাকে পুষতে চাইল। আমি ঘরে শান্তি বজায় রাখতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। সে মনে করল এটাকে মায়া মমতা দিয়ে পোষ মানানো সম্ভব। এটা তখন বেশ ভালো একটা পোষ্য হতে পারে। আমি তাকে বললাম, একুশ’ ফুট উচ্চতা এবং চুরাশি ফুট দৈর্ঘ্যের একটা পোষ্য আমাদের জায়গার জন্য আদৌ মানানসই নয়। কারণ, এটা তার সমস্ত ভালো গুণাবলী নিয়ে, কোনোরকম ক্ষতিকারক চিন্তাভাবনা ছাড়াই শুধুমাত্র যদি বসে পড়ে, তাহলেই আমাদের ঘরটা স্রেফ ভর্তা হয়ে যাবে। কারণ, এর চাউনি দেখলে যে কেউই বুঝতে পারবে এটা কতটা অন্যমনস্ক একটা জীব।

এরপরেও তার হৃদয় ওই দৈত্যাকৃতি জীবটার জন্যেই আটকে রইল, সে ওটাকে যেতে দিতে চায় নি। সে এটা দিয়ে একটা দুগ্ধখামার করতে চাইল, এবং আমাকে বলল দুধ সংগ্রহে সাহায্য করতে। আমি করি নি। কাজটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওটা মেয়ে জীব নয়, তাছাড়া আমাদের কোনো মই ছিল না। তখন সে আশপাশের দৃশ্য দেখতে এটার পিঠে চড়ে বসতে চাইল। পড়ে যাওয়া একটা গাছের মতো ওটার ত্রিশ বা চল্লিশ ফুট লম্বা লেজটা মাটিতে শোয়ানো ছিল এবং সে ভেবেছিল, সে এটা বেয়ে উঠতে পারবে, কিন্তু সে ভুল করেছিল। সে যখন খাড়া জায়গাটাতে পৌঁছল, জায়গাটা ছিল খুবই পিচ্ছিল, এবং সে পিছলে নিচে পড়ে গেল। আমাকে নয়, সে নিজেকেই আহত করতে যাচ্ছিল।

এখন কী সে সন্তুষ্ট? না, প্রদর্শন করা ছাড়া আর কিছুতেই তো সে পরিতৃপ্ত হয় না। পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়, আর সম্ভব হবেও না। তার মনটা খাঁটি, আমি সেটা স্বীকারও করি। সেটা আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি তার প্রভাব অনুভব করি। আমার ধারণা, আমি যদি তার সঙ্গে আরও বেশী সময় কাটাই আমি প্রায় তার মতো হয়ে যাব। যাই হোক, এখন তার ওই বিশালাকার জীবটাকে নিয়ে আর মাত্র একটা পরীক্ষাই অবশিষ্ট আছে। সে এখন ওটাকে পোষ মানিয়ে, নদীতে সেতু হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। দেখা গেল, ওটা ইতোমধ্যে যথেষ্ট পোষ মেনে গেছে – তার হিসেবে -অতএব সে তার পরীক্ষা শুরু করল এবং ব্যর্থ হলো। যতবারই সে ওটাকে নদীতে ঠিকভাবে বসিয়ে দিয়ে তীরে চলে আসে, একটা পোষা পাহাড়ের মতো ওটাও তাকে অনুসরণ করে তার পেছন পেছন আসে। বাকি জীবজন্তুর মতো। জন্তুগুলো সব একই কাজ করে।

 


শুক্রবার: মঙ্গল-বুধ -বৃহস্পতি এবং আজ। এতগুলো দিন তার সঙ্গে দেখা হয় নি। সুদীর্ঘ নিঃসঙ্গ সময়। অবশ্য, অনাকাঙিক্ষত হয়ে থাকার চেয়ে একলা থাকাই ভালো।

আমার সঙ্গী দরকার, আমাকে এজন্যই তৈরি করা হয়েছে, আমার মনে হয় – তাই আমি পশুপাখিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে শুরু করলাম। পশুপাখিরা অনেক ভালো, ওদের স্বভাব অনেক বিনয়ী এবং শান্ত। তাদেরকে কখনো বিরক্ত দেখায় না, তারা কখনোই তোমাকে অনাহূত বোধ করাবে না, তারা তোমাকে দেখে আনন্দে লেজ নাড়বে, যদি তাদের লেজ থেকে থাকে। তারা সবসময় দৌড়ঝাঁপ করতে অথবা ঘুরতে যেতে প্রস্তুত, অথবা যেটা তুমি বলবে। আমার হিসেবে এরাই প্রকৃত ভদ্রলোক। এই যে এতগুলো দিন, আমরা খুবই ভালো সময় কাটিয়েছি। এবং দিনগুলো আমার জন্য একটুও নিঃসঙ্গ ছিল না, একটুও না। একাকীত্ব! না, আমি বলতেই পারি, সেটা ছিল না।

কীভাবে থাকবে, যেখানে সবসময় পুরো এক দঙ্গল পশুপাখি চারপাশে ঘিরে ঘোরাঘুরি করে, – কখনো কখনো এত বিশাল পরিমাণে, প্রায় চার পাঁচ একর জুড়ে – গুনে শেষ করা যাবে না। যদি এই বিস্তীর্ণ পশুদের অবস্থানে তৈরি পশমী এলাকার মাঝখানে একটা পাথরের ওপরে উঠে তাকানো যায়, দেখা যাবে কত হরেক রঙে রঙিন হয়ে ছড়ানো আনন্দোচ্ছল বর্ণালী পশুদের লাফালাফি, যা সূর্যালোকে ঝলমল করছে। অবিকল দড়ি দিয়ে আটকানো ঢেউয়ের মতো এর ওঠানামা, একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, যেন একটা দিঘি। অথচ এটা দিঘি নয়। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের সম্মিলিত স্রোত, তাদের ঝড়ের শব্দ তোলা ঝাপটানো ডানার ওপরে যখন সূর্য তার প্রখর তাপ বিকিরণ করে, তখন আলোকিত পালক সারির ঝলসে ওঠা যেন রঙে রঙে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়।

আমরা অনেক লম্বা পথ ঘুরে বেড়ালাম। পৃথিবীর অনেকটা দেখলাম, সম্ভবত প্রায় পুরোটাই। সুতরাং আমিই পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র ভ্রমণকারী। আমাদের এই ভ্রমণ, একটা দেখার মতো দৃশ্য ছিল –এ রকম দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ার মতো নয়।

ভ্রমণের সময় আরামদায়ক বলে আমি বাঘ অথবা চিতাবাঘের পিঠে চড়তাম, এর পিঠটা নরম আর পেছনটা গোলাকার বলে বসার জন্য সুবিধাজনক, তাছাড়া এই প্রাণীগুলো দেখতে সুন্দর। কিন্তু দূরত্ব বুঝতে অথবা আশেপাশের দৃশ্যাবলি দেখতে হলে আমি হাতির পিঠে চড়তাম। সে তার শুঁড় দিয়ে আমাকে পিঠে তুলে নিত, নেমে যাওয়ার সময় হলে আমি নিজেই নেমে যেতে পারতাম। আমাদের বিশ্রামের দরকার হলে সে বসে পড়ত আর আমি পিছলে পেছন থেকে নেমে যেতাম।

পশু এবং পাখিরা সবাই একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো কিছু নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিল না। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলত। তারা আমার সঙ্গেও কথা বলত, কিন্তু ভাষাটা নিশ্চই বিদেশী কোনও ভাষা, কারণ আমি ওদের কথার একটা বর্ণও বুঝতে পারতাম না। যদিও ওরা আমার বলা কথা অনেক সময়েই বুঝতে পারত, বিশেষত কুকুর এবং হাতি। এটা লজ্জাজনক ব্যাপার। দেখা যাচ্ছে, ওরা আমার থেকে বেশি মেধাবী। অথচ, আমি নিজেকে পরীক্ষণের মূল বিষয়বস্তু হিসেবে দেখতে চাই -এবং হতেও চাই।

এখন আমি অনেক কিছু শিখেছি, এবং আমি এখন শিক্ষিত। যেটা আগে ছিলাম না। শুরুতে আমি মূর্খ ছিলাম। প্রথম প্রথম এই ভাবনাটা আমাকে যন্ত্রণা দিত যে, যতই চোখে চোখে রাখি না কেন, কখনোই ঝর্ণার পানির ওপরের দিকে প্রবাহিত হওয়াটা আমি দেখতে পেতাম না। এখন আর এটা নিয়ে ভাবি না। আমি এখন পর্যন্ত অনেক অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জেনেছি যে, পানি কখনোই ওপরের দিকে প্রবাহিত হয় না, গাঢ় অন্ধকার ছাড়া। আমি জানি, এই ঘটনাটা একমাত্র গভীর রাতেই ঘটা সম্ভব কারণ জলাধারটা কখনোই শুকিয়ে যায় না। অথচ শুকিয়ে যাওয়ার কথা, যদি প্রতি রাতে পানি আবার জলাধারে ফিরে না আসত। যে কোনো কিছুকে সত্যিকার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত করা উত্তম, তাহলেই জানাটা সঠিক হয়। যদি অনুমান, সম্ভাবনা এবং ধারণার ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে কিছুই শেখা সম্ভব না।

ধরো, কিছু একটা তুমি খুঁজে পাচ্ছ না। তুমি কখনোই অনুমান করে বা সম্ভাব্যতা বিচার করে ব্যাপারটা জানতে পারবে না। তোমাকে ধৈর্য্য ধরে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছ। আর এভাবে জানতে পাওয়াটা সত্যিই আনন্দদায়ক। এ কারণেই পৃথিবী আকর্ষণীয়। যদি আবিষ্কার করার মতো কিছু না থাকত তাহলে সবকিছু নিষ্প্রভ হয়ে যেত। এমনকি আবিষ্কারের চেষ্টা করে আবিষ্কার করতে না পারাটাও আবিষ্কার করতে পারার মতোই একটা ব্যাপার। বরং হতে পারে আরো বেশী চিত্তাকর্ষক। পানির এই রহস্যটা আমার কাছে গুপ্তধনের মতো ছিল, যতক্ষণ না আমি এর রহস্য ভেদ করেছি। এরপরে আমি এর সমস্ত উত্তেজনা হারিয়ে ফেললাম, যেন একটা বিশাল অপ্রাপ্তির বোধ তৈরি হলো।

পরীক্ষার মাধ্যমে আমি জানতে পারলাম, কাঠ পানিতে ভাসে, এবং শুকনো পাতা, পালক, এবং আরো অনেক কিছুই পানিতে ভাসতে পারে। এইসব ক্রমবর্ধমান প্রমাণের ভিত্তিতে তুমি জানবে পাথরও ভাসবে। কিন্তু তোমাকে শুধু জেনেই বসে থাকতে হবে কেননা এটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই – অন্তত এখন পর্যন্ত। কিন্তু আমি ঠিকই একটা উপায় বের করব -তখন এটার সমস্ত উত্তেজনা হারিয়ে যাবে। এটা আমার খারাপ লাগে। কারণ ধীরে ধীরে যতই সবকিছু আবিষ্কার করছিলাম, ততই সবকিছু থেকে উত্তেজনা হারিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে চলতে থাকলে আর কোনো আকর্ষণই অবশিষ্ট থাকবে না। আমি কোনো কিছুতে মেতে থাকতে ভীষণ ভালোবাসি। গতরাতে এটা ভাবতে গিয়ে আমার ঘুমই হলো না।

শুরুতে আমি জানতাম না আমাকে কেন তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু এখন আমার মনে হয় এই বিস্ময়কর পৃথিবীর গোপন রহস্যগুলো খুঁজে বের করে আনন্দ পাওয়া এবং সবকিছু সৃষ্টির জন্য স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য আমার সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় আমার এখনো অনেক কিছুই শেখা বাকি – আমি সেটাই চাই। এবং তাড়াহুড়ো না করে ধীরে সুস্থে শিখতে থাকলে রহস্যগুলো সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে টিকে থাকবে। আমি সেটাই চাই।

একটা পালক বাতাসে উড়িয়ে দিলে সেটা ভেসে ভেসে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। কিন্তু একটা মাটির ঢেলা তা করে না। সেটা নিচে নেমে আসে, প্রতিবার। আমি বারবার চেষ্টা করে দেখেছি, এটাই ঘটে সবসময়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, কেন এমন হয়? অবশ্যই এটা নিচে নেমে আসে না, তাহলে কেন এটা নিচে নেমে আসছে বলে মনে হবে? আমার ধারণা এটা দৃষ্টির একটা বিভ্রম। মানে, দুটো ঘটনার যে কোনো একটা দৃষ্টিবিভ্রম। কোন্‌টা, তা আমি জানি না। হতে পারে পালক, অথবা মাটির ঢেলা। আমি কোনোটাই প্রমাণ করতে পারব না, আমি শুধু দেখাতে পারব। এর যে কোনো একটা মেকি, মানুষ তার নিজের ইচ্ছা অনুসারে যে কোনো একটা বেছে নেবে।

দেখতে দেখতে আমি বুঝলাম, নক্ষত্রগুলো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে না। আমি বেশ উজ্জ্বল কিছু তারাদের গলে ছুটে পড়ে যেতে দেখেছি। যদি একটা তারা গলে যেতে পারে, বাকি সমস্ত তারারাও গলে যেতে পারে, এক রাতের মধ্যে। আমার দুঃখের দিন আসতে চলেছে -আমি বুঝে গেছি। আমি তারাদের দেখার জন্য প্রতি রাতে নিজেকে যতক্ষণ পারলাম জাগিয়ে রাখলাম। আমি ওদের ঝিকিমিকি দৃশ্য স্মৃতির মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখব, যাতে করে যখন তারাগুলি থাকবে না আমি আমার স্মৃতি থেকে অগুনতি জ্বলজ্বলে তারাদের এনে অন্ধকার কালো আকাশে আবার সাজিয়ে দেব আমার কল্পনায়, আরো দ্বিগুণ করে দেখব আমার কান্না ভেজা ঝাপসা চোখে।

 

স্বর্গ থেকে পতনের পর
আমি যখন আগের কথা মনে করি, বাগানটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। ওটা ছিল সুন্দর, অদ্ভুত রকমের সুন্দর, মায়াময়। এখন সেটা নেই, আমি আর কখনো বাগানটা দেখতে পাব না।

বাগান হারিয়ে গেছে কিন্তু আমি ‘তাকে’ পেয়েছি, আমি পরিপূর্ণ। সে আমাকে ভালোবাসে, যতটুকু তার পক্ষে বাসা সম্ভব। আমি তাকে আমার আবেগময় স্বভাবের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে ভালোবাসি। যা আমার তারুণ্য এবং নারীত্বের জন্য উপযুক্ত। আমি যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কেন তাকে ভালোবাসি, আমি এর কোনো উত্তর খুঁজে পাই না, এবং খোঁজার খুব একটা পরোয়াও করি না।

তো, আমার মনে হয় এ ধরনের ভালোবাসা কোনো প্রকারের কোনও কারণ অথবা পরিসংখ্যান নির্ভর কিছু নয়। যেমনটা কিনা কোনো প্রাণী অথবা সরীসৃপের বেলায় ঘটে। আমার ধারণা, এই ভালোবাসা এমনই। আমি কিছু নির্দিষ্ট পাখিদের ভালোবাসি ওদের মিষ্টি গানের জন্য।

কিন্তু অ্যাডামকে আমি তার গানের জন্যে ভালোবাসি না — না, ব্যাপারটা এটা নয়। ও যত গান করে, আমি তত ব্যাপারটা মেলাতে পারি না। যদিও আমিই ওকে গান গাইতে বলি, কারণ, আমি ওর পছন্দের বিষয়গুলো জানতে চাই। ওর পছন্দগুলোকে পছন্দ করা শিখতে চাই। আমি নিশ্চিত, আমি শিখে ফেলব। কারণ, আগে আমি এটা সহ্যই করতে পারতাম না, এখন পারি। এটা দুধকে টক করে ফেলে, ব্যাপার না। আমি টক দুধেই অভ্যস্ত হয়ে যাব।

আমি ওকে ওর মেধার জন্য ভালোবাসি না — না, ব্যাপারটা এটিও নয়। এখানে তার কোনও ভূমিকা নেই, কারণ, সে নিজেই নিজেকে তৈরি করে নি। ঈশ্বর তাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, সে তেমন। এবং সেটাই যথেষ্ট। এর ভেতরে একটা অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে, আমি এটুকু বুঝতে পারি। ধীরে ধীরে সেটা স্পষ্ট হবে, হঠাৎ করে একদিনে নয়। তাছাড়া, এখানে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সে যেমন আছে, ভালোই আছে।

আমার ভালোবাসা তার দয়ালু স্বভাব, বিবেচনা করবার ক্ষমতা কিংবা তার মার্জিত আচরণের জন্য নয়। বরং এসব বিষয়ে তার যথেষ্ট খামতি রয়েছে। কিন্তু সে যেমন আছে সেটা ঠিক আছে এবং সে এই বিষয়ে একটু একটু করে ভালো করছে।

আমি তাকে ভালোবাসি তার কর্মদক্ষতার গুণের জন্য নয় — না, এটা সেরকম কিছু নয়। কর্মদক্ষতা তার প্রকৃতিগত গুণ, আমি বুঝি না সে কেন ব্যাপারটা আমার কাছে গোপন রাখতে চায়। এটাই আমার একমাত্র কষ্ট। এছাড়া এখন সে বেশ উদার এবং খোলা মনের। আমি নিশ্চিত সে আমার কাছে কিছুই লুকায় না, একমাত্র এটা ছাড়া। আমার কাছে তাকে কিছু একটা গোপন রাখতে চাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে যন্ত্রণা দেয়। কখনো কখনো এই ভাবনা আমার ঘুম নষ্ট করে। কিন্তু আমি এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেব। এটাকে আমার উপচে পড়া সুখের কাঁটা হতে দেব না।

আমি ওকে ভালোবাসি ওর জ্ঞানের জন্য নয় – না, এটা তা নয়। সে স্বশিক্ষিত এবং সত্যিই অনেককিছু সম্পর্কে জানে। কিন্তু, কারণ সেটাও নয়।

তার প্রতি আমার ভালোবাসা তার শৌর্যর জন্য নয় – না, ব্যাপারটা এটাও নয়। সে আমাকে ওটা বলেছিল, কিন্তু তাকে এ ব্যাপারে দোষ দেওয়া যায় না। আমার মনে হয় এটা পুরুষের বিশেষত্ব, এবং সে নিজেকে পুরুষ হিসেবে তৈরি করে নি। অবশ্য আমি হলে তাকে এটা কখনোই বলতাম না। আমি নিজেই শেষ হয়ে যেতাম, তবুও বলতাম না। এবং এটাও নারীর বিশেষত্ব। এখানে আমারও কোনো ভূমিকা নেই কারণ আমি নিজেকে নারী হিসেবে তৈরি করি নি।

তাহলে কী কারণে আমি তাকে ভালোবাসি? সে পুরুষ, তাই। আমার ধারণা। নীচের দিকটায় সে ভালোই, আমি সে কারণে তাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি তাকে ওটা ছাড়াই ভালোবাসতে পারি। যদি সে আমাকে অত্যাচার করে, পেটায় তবুও আমি তাকে ভালোবেসে যাব, আমি জানি। এটা বোধহয় নারীপুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ।

সে শক্তিশালী এবং সুদর্শন, আমি এ কারণে তাকে ভালোবাসি এবং তাকে শ্রদ্ধা করি, তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। কিন্তু আমি তাকে এসব গুণাবলী ছাড়াও ভালোবাসতে পারি। যদি সে পুরোটা সমানও হতো, আমি তাকে ভালোবাসতাম। যদি সে ধ্বংসাত্মক হতো, আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং তার জন্য কাজ করতাম, তার জন্য দাস হতাম, তার জন্য প্রার্থনা করতাম, এবং আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকতাম।

হ্যাঁ, আমার মনে হয়, আমি তাকে ভালোবাসি কারণ সে পুরুষ এবং সে ‘আমার।’ আর কোনও কারণ নেই, আমি অন্তত দেখি না। এবং আমি আরো মনে করি, যেমনটা শুরুতেই বলেছিলাম যে, এ ধরনের ভালোবাসা কোনো প্রকারের কোনো কারণ অথবা পরিসংখ্যান নির্ভর কিছু নয়। এটা স্রেফ হয়ে যায় – কেউ জানে না কখন — এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যার দরকারও নেই।

এটা আমার ভাবনা। কিন্তু আমি শুধুই বালিকা মাত্র, পৃথিবীর এবং নিজের জীবনের প্রথম, যে বিষয়টা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করল, হতে পারে আমার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে আমি সঠিক নই।

 

চল্লিশ বছর পরে
এটাই আমার প্রার্থনা, আকাঙ্ক্ষা, আমরা যেন একসঙ্গে এই জীবন থেকে বিদায় নিতে পারি — এমন আকাঙ্ক্ষা যা কখনো পৃথিবী থেকে শেষ হবে না বরং জগতের প্রতিটি প্রেমময়ী স্ত্রীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে রবে। এবং এটাকে আমার নাম দিয়ে ডাকা হবে।

কিন্তু যদি আমাদের মধ্যে কাউকে আগে চলে যেতেই হয়, আমার প্রার্থনা, তবে সেটা যেন আমি হই। কারণ, সে শক্তিশালী, আমি দুর্বল, সে আমার জন্য যতটা প্রয়োজনীয়, আমি তার জন্য ততটা নই – তাকে ছাড়া যে জীবন, সেটা কোনো জীবন নয়। এখন কী আমার পক্ষে এমন জীবন সহ্য করা সম্ভব? এই প্রার্থনাও চিরন্তন এবং এই কামনার কখনো শেষ হবে না। এই প্রার্থনার কামনায় আমি প্রবহমান থাকব। আমি পৃথিবীর প্রথম স্ত্রী, পৃথিবীর শেষ স্ত্রীর মধ্যেও আমার পুনরাবৃত্তিই ঘটতে থাকবে।

 

ইভের সমাধিস্থলে
অ্যাডাম: সে যেখানে ছিল, সেটাই স্বর্গ ছিল। ❑

 

 

 

 

 

 

 

Share With:
Rate This Article
No Comments

Leave A Comment