Our Concern
Ruposhi Bangla
Hindusthan Surkhiyan
Radio Bangla FM
Third Eye Production
Anuswar Publication
Ruposhi Bangla Entertainment Limited
Shah Foundation
Street Children Foundation
March 29, 2024
Homeপ্রধান সংবাদকেনু মিস্ত্রি- একজন ক্ষণজন্মা স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী

কেনু মিস্ত্রি- একজন ক্ষণজন্মা স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী

কেনু মিস্ত্রি- একজন ক্ষণজন্মা স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী

এ বছর পয়লা জানুয়ারিতে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটা খবর এল, ‘স্বশিক্ষিত লোকজ কৃষিবিজ্ঞানী কেনু মিস্ত্রি আর নেই।’ একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে আসা ৮৫ বছর বয়সি এই ক্ষণজন্মা মানুষটির মৃত্যুর খবর অনলাইনেই দেখা যাচ্ছিল ওদিন। ছাপানো কাগজে এসেছে পরের দিন। কে ছিলেন এই কেনু মিস্ত্রি? স্বশিক্ষিত মানে তো যিনি কখনও প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেন নি। তাহলে এমন একজন মানুষ বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন কি করে! চলুন, আমরা কেনু মিস্ত্রীর গল্পটা একটু জেনে আসি।
গৌরীপুর। ইরি ধানের মৌসুম আসছে। চাষ শুরু করতে হবে। ক্ষেতের জমিতে খুব আগাছা জমেছে। চাষ শুরু করতে হলে আগাছা পরিষ্কার করা দরকার। কৃষক ফজলুর রহমান ছেনি হাতে সকাল থেকেই ক্ষেতের ঘন আগাছা পরিষ্কার করতে লেগে গেছেন। সারাদিন রোদে পুড়ে পুড়ে প্রচন্ড পরিশ্রমে কাজ করতে করতে দিন শেষে দেখা গেল তিনি সবেমাত্র দু শতাংশ জমির আগাছা পরিষ্কার করতে পেরেছেন। বড়ভাইয়ের প্রচন্ড পরিশ্রমে আগাছা পরিষ্কার করবার ওই দৃশ্য দেখছিল। দেখার পর বিষয়টা কেনুকে নাড়া দিল খুব। সে রাতে ঘুমাতে গিয়ে বিছানায় শুয়ে কেনু  ভাবতে থাকে কিছু একটা করা দরকার। ফজলুর রহমানের ছোটভাই  মো. আবদুল্লাহ আল পাঠান।  পেশায় কাঠমিস্ত্রি। কেনু নামেই সকলে ডাকে তাকে। পেশার কারণে কাঠমিস্ত্রি থেকে কেনু মিস্ত্রি।
বিছানায় শুয়ে বড়ভাইয়ের রোদে পুড়ে আগাছা পরিষ্কার ঘুমাতে দেয় না তাকে। ভাবতে থাকে কেনু। শেষ রাতের দিকে কেনুর মাথায় একটা পরিকল্পনা আসে। তখনই ছোট ছোট কিছু লোহার পাত আর কিছু কাঠের টুকরো নিয়ে বসে যান তিনি। কাঠের টুকরোগুলোর সঙ্গে লোহার পাতগুলো জুড়ে জুড়ে বানিয়ে ফেলেন লম্বা হাতলওয়ালা একটা নিড়ানী। যন্ত্রটার একটা নামও দিলেন কেনু। ‘সেনি উইডার।’ পরদিন সেই যন্ত্র নিয়ে কেনু নিজেই নেমে পড়লেন ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে। আধ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই পরিষ্কার করে ফেললেন পাঁচ শতাংশ জমির আগাছা। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এলাকায়। কৃষকদের ভেতর একটা আলোড়ন তৈরি করল সে খবর। তখনই সকলে ছুটে আসতে লাগল কেনুর কাছে।
ওপরের ওই গল্পটি আটচল্লিশ বছর আগের, ১৯৭২ সালের একটি ঘটনা। গল্পের নায়ক কেনুর কৃষিবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পথটাতে হাঁটা শুরু হলো এভাবেই। পেশায় কাঠমিস্ত্রি মো. আবদুল্লাহ আল পাঠানকে এখন পুরো বাংলাদেশের মানুষেরা কেনু মিস্ত্রি নামেই চেনে। কেনু মিস্ত্রি বাংলাদেশের স্বীকৃত কৃষিবিজ্ঞানী। অথচ তার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কখনও স্কুল-কলেজে যান নি। প্রকৃতিই তার শিক্ষক। কৃষিবান্ধব যন্ত্রপাতি তৈরির কারিগর তিনি। এলাকায় তিনি লোকজ কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবেই পরিচিত।

উদ্ভাবন মেলায় নিজের স্টলে নিজের উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্র প্রদর্শন করছেন কেনু মিস্ত্রি।

‘লোকটা দেখতে পুরোপুরি আইনস্টাইনের মতো। আইনস্টাইনের মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল ছিল, তবে উনার মাথায় সবুজ পাগড়ি। আইনস্টাইনের মুখে দাঁড়ি ছিল না, কিন্তু উনার আছে।’ ২০১৪ সালে জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন আয়োজিত উদ্ভাবন মেলায় কেনু মিস্ত্রির সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তার কাজ সম্পর্কে জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন তখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আর কৌতুকে কথাগুলো সাবেক মন্ত্রী বলেছিলেন কেনু মিস্ত্রি সম্পর্কে।
সেই হাতলওয়ালা সেনি উইডার দিয়ে শুরুর পর কেনু মিস্ত্রি একে একে তৈরি করেছেন আরও ৪৪টি কৃষিযন্ত্র।
কেনু মিস্ত্রি উদ্ভাবিত উল্লেখযোগ্য কৃষিযন্ত্রগুলো হচ্ছে – সেনি উইডার, আধুনিক ধানমাড়াইয়ের যন্ত্র, ফসলের মাটি ঝুরঝুরা করার ‘বিন্দাযন্ত্র’, খুব সহজে মাটি খননের ‘আগরযন্ত্র’, গোল আলুর বীজ বপনযন্ত্র, নির্দিষ্ট দূরত্বে শস্যবীজ বপনযন্ত্র, সবজি বীজ বপনযন্ত্র, সবজি গাছের ডগা কেটে ফেলার ‘কাটারযন্ত্র’, ক্ষেত বা উঁচু গাছে কীটনাশক স্প্রে করার যন্ত্র, সবজির চারা উত্তোলন যন্ত্র, আধুনিক দা, আধুনিক ক্ষন্তা, আধুনিক কাঁচি, আধুনিক কোদাল, গুটিসার প্রয়োগযন্ত্র, সহজে জমিতে সেচ দেওয়ার ‘পাডাকল’, পানি সেচের ‘হাতকুন্দা’ সেমাই বানানোর যন্ত্র, গভীর কাদা থেকে সহজেই মাছ শিকারের জন্য ‘হয়ড়া’, কৃষিভেদে চার ধরনের নিড়ানী যন্ত্রসহ বিভিন্ন হস্তচালিত কৃষিযন্ত্র।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের কৃষি উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এই বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কেনু মিস্ত্রির নির্মিত হস্তচালিত কৃষি যন্ত্রপাতিরও যে বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ কেনু মিস্ত্রির তৈরি এসব কৃষিযন্ত্রের বিশেষ কোনও নাম কিংবা পেটেন্ট না থাকলেও স্থানীয় নাম নিয়েই দেশের কৃষি অগ্রযাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে৷
কেনু মিস্ত্রির তৈরি কৃষি যন্ত্রগুলো দামেও খুব সস্তা। এগুলো তৈরিতে বাঁশ, কাঠ, ইস্পাত, স্টিল, লোহা ও সাইকেলের  চেইন ছাড়া  আর কোনও দামি উপকরণের দরকার পড়ে না। এসব যন্ত্র গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার কৃষকেরা ব্যবহার করছেন। কেনু মিস্ত্রির উদ্ভাবন করা অধিকাংশ যন্ত্রপাতি স্থান পেয়েছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জাদুঘরে।

নিজের উদ্ভাবিত নানারকম কৃষিযন্ত্র নিয়ে কেনু মিস্ত্রি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জাদুঘরের ছয়টি কক্ষের পাঁচটিতেই কেনু মিস্ত্রির উদ্ভাবন করা  প্রায় ২০টি কৃষিবান্ধব যন্ত্রপাতি রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহনকারী আরও প্রায় ৩০টি দর্শকনন্দিত শৌখিন শৈল্পিক সামগ্রী। জাদুঘরের ৫ নম্বর কক্ষে কেনু মিস্ত্রির তৈরি ‘কৃষকের বসতবাড়ি’ শিরোনামে চমৎকার আর অসাধারণ একটি শৈল্পিক সৃষ্টিকর্ম স্থান পেয়েছে৷

কেনু মিস্ত্রির উদ্ভাবিত যন্ত্র সারাদেশের কৃষকের কাছে পোঁছে দিয়ে উৎপাদনে সহায়তা করতে সরকারের সহায়তা চেয়েছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেনু মিস্ত্রিকে দু বছরের ফেলোশিপ দিয়ে তার সকল সাশ্রয়ী ও কার্যকর যন্ত্রপাতিগুলো বানিয়ে নিয়েছে। সেগুলো বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে।
কেনু মিস্ত্রি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে স্থানীয় জেলা, উপজেলা কৃষি বিভাগ ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা থেকে পেয়েছেন অসংখ্য সনদ ও সম্মাননা।

কেনু মিস্ত্রি নামের এই মানুষটির খোঁজ দিয়েছিলেন লেখক ও গবেষক আইয়ুব হোসেন। যিনি ঠিক এভাবেই একদিন আবিষ্কার করেছিলেন, আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের সঙ্গে। কেনু মিস্ত্রিকে নিয়ে লেখক ও গবেষক আইয়ুব হোসেনের একটি রচনা খুব শীঘ্রই প্রকাশের প্রয়াস আমাদের থাকবে। প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য রাখুন।
-নির্বাহী সম্পাদক
Share With:
Rate This Article
No Comments

Leave A Comment