তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কমিয়ে আনার প্রস্তাব দিল্লির, ঢাকার দৃষ্টি পানি বণ্টনে: টেলিগ্রাফের রিপোর্ট
তিস্তা ইস্যুতে চীনের প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি লবি খুব আগ্রহী। এ বিষয়ে কিছু আলোচনাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে এটা এড়িয়ে গেছেন যে, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে অচলাবস্থা তার সমাধানের বিষয়ে নয়াদিল্লি কোনো সমাধান দেবে সে বিষয়ে তিনি আশাবাদী। একই সঙ্গে তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কমিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু ঢাকার দৃষ্টি পানি বণ্টনে। ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক দেবাদীপ পুরোহিত। তিনি আরও লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিরল অবগুণ্ঠনে থাকা ‘লুক টু চায়না’র কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের নেতৃত্বে একটি দ্রুতগতির উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেটা হলো তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সিস্টেম। শেখ হাসিনার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত যৌথ ব্রিফিংয়ে মোদি বলেছেন, তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনার জন্য খুব শিগগিরই ভারতের একটি টেকনিক্যাল টিম ঢাকা সফরে যাবে। ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত ‘গঙ্গা ওয়াটার ট্রিটি’ নবায়নের জন্য আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি।
ওই চুক্তি ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ আছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তা পুনরুদ্ধার এবং ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চীনের একটি প্রস্তাব তিনি বিবেচনা করছেন। এর ১০ দিন পরেই ভারতের এই উদ্যোগের কথা সামনে এলো।
দেবাদীপ পুরোহিত লিখেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করতে নয়াদিল্লির ব্যর্থতাকে বড় করে দেখছেন ঢাকার কিছু সূত্র। এই ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তা কমপক্ষে এক দশক ধরে তীব্র বিলম্বিত ও সময়ক্ষেপণের ইস্যু হয়ে আছে। বাংলাদেশে পানিসম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, নয়াদিল্লি যে প্রস্তাব দিয়েছে তাকে ভারতের সময়ক্ষেপণের একটি কৌশলের ঝুঁকি হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদি তারা দ্বিমুখী পদ্ধতি অবলম্বন না করে একটি ‘স্টাডি টিম’ পাঠায় তাহলে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হবে। প্রথমত, তারা (পানি বণ্টন নিয়ে) অন্তর্বর্তী একটি ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব দেবে। দ্বিতীয়ত, তারপর নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তায় যে পরিমাণ পানিই থাকুক না কেন তার নির্বিশেষে বৈধ দাবিদার বাংলাদেশ। পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তী একটি ব্যবস্থাপনা ছাড়া স্টাডি টিম পাঠানোর প্রস্তাবকে ভারতের সময়ক্ষেপণের একটি কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
দেবাদীপ পুরোহিত আরও লিখেছেন, শনিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের আলোচনা শুরুর বিষয়ে কথা বলেছেন। এই চুক্তিটি বহাল আছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া বাংলাদেশিদের জন্য ই-ভিসা ইস্যুর সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তির জন্য, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকার অপেক্ষায় আছে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। এ বিষয়টি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিস্তা হলো দুই দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে চতুর্থ বৃহৎ। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে বাগড়া দিয়ে বসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকা বলছে, একটি চুক্তি করতে ব্যর্থতার মূল্য দিতে হচ্ছে (বাংলাদেশকে)। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে তিস্তার পাড়ে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমি পানির অভাবে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের বাইরে থাকছে।
এই পটভূমিতে শেখ হাসিনার কাছে গ্রহণযোগ্য সহায়তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বেইজিং। তারা প্রায় চার বছর আগে তিস্তা নদীতে বহুমুখী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। ১০০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ড্রেজিং, জলাধার নির্মাণ, নদী বরাবর একটি ড্রেনেজ সিস্টেম, নদীর পাড় নির্মাণ এবং উভয়তীরে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ। চীনের এই প্রস্তাব নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি লবি খুব আগ্রহী। তারা এরই মধ্যে কিছু আলোচনাও সেরে ফেলেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে এটা এড়িয়ে গেছেন যে, নয়াদিল্লি তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে অচলাবস্থার একটি সমাধান দেবে- এ ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। তবে ইঙ্গিত মিলেছে যে, তিনি হয়তো ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। গত সপ্তাহে তিনি জাতীয় সংসদে বলেছেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ডিভিশন কমিটি এই প্রকল্পে আরও সহজ শর্তে অর্থায়নে চীন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে। এই কমিটি বিদেশি তহবিল সংগ্রহের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
ঢাকার একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাংলাদেশে টেকনিক্যাল টিম পাঠানোর জন্য ভারত যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে সুনির্দিষ্টতার অভাব আছে। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রস্তাব দেখার বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন তার প্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে এই পদক্ষেপের কথা বলেছে ভারত। কয়েক বছর ধরে চীনের এই প্রস্তাব আমাদের কাছে। প্রকৃতপক্ষে দিনের শেষে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবের কথা বলেননি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাত্রা। যদিও তিনি বলেছেন, উৎসের পানি বণ্টন ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়। দুই নেতা আলোচনা করেছেন যে, তিস্তা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু মাত্রার প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। তবে তিনি পানি বণ্টন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বিনয় খাত্রা আরও বলেন, পানিবণ্টনের দিক দিয়ে এটা অনেকটাই কম, তবে তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব হলো তিস্তা নদীর ভেতরে পানির প্রবাহ ব্যবস্থাপনার বিষয়।
ঢাকায় ক্ষমতাসীন এস্টাবলিশমেন্টের বহু সূত্র ভারতের এই পত্রিকাটিকে বলেছেন, তিস্তাকে উল্লেখ করায় মোদির প্রশংসা করেন তারা। এটি গত এক দশক বা তারও বেশি সময় অফিসিয়াল পর্যায়ের মিটিংয়ের সময় ছিল (এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম) এমন ইস্যু যা সবাই জানতো, কিন্তু মুখ খুলতো না। তারা আরও বলেন, ‘পানি বণ্টন’-এর কোনো উল্লেখ না থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারকে আরও বেশি জটিল সমস্যায় ফেলবে।
এ বছর শুরুর দিকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বেশ কিছু কারণে তার সরকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার মধ্যে আছে দেশের অর্থনৈতিক কঠিন পরিস্থিতি থেকে এমন একটি ধারণা- যা হলো ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাওনা আদায়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। শেখ হাসিনার কিছু ঘনিষ্ঠ মানুষ সহ আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ চান যে, শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে অধিক পরিমাণ যোগাযোগ রক্ষা করুন। একটি সূত্র বলেছেন, বেইজিংয়ের প্রস্তাব নিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় অলস বসে থাকতে পারেন না। ওই সূত্রটি আরও বলেন, তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি চীন সফরে যাবেন। আপনি এমন সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দিতে পারবেন না যে, তিস্তা প্রকল্প চীনের কাছে হস্তান্তরের সম্ভাবনা কমাতে ভারত ওই প্রস্তাব তুলে ধরেছে।
দেবাদীপ আরও লিখেছেন, তিস্তা ব্যবস্থাপনা চীনের হাতে চলে যাওয়া ঠেকাতে ভারত মরিয়া। এটা শুধু সবচেয়ে আস্থাশীল প্রতিবেশীর সঙ্গে ‘পানি-কূটনীতি’র ব্যর্থতার ইঙ্গিতই নয়। একই সঙ্গে কৌশলগত বড় এক উদ্বেগের বিষয়। ঢাকা যদি চীনের সঙ্গে খেলাটা জমিয়ে তোলে, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চীনের উপস্থিতি চলে আসবে, চিকেন নেকের একেবারে কাছে চলে আসবে। চিকেন নেক হলো পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের ভূ-ভাগের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাকি অংশের সঙ্গে সংকীর্ণ একটি এলাকা। একটি সূত্রের মতে, শুধু চীনের প্রভাবের দিক থেকেই ভারত সরকার তিস্তা নিয়ে ঘোষণা দিয়েছে এমন নয়। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার সফরের সময়ও একটি ফ্যাক্টর। ঢাকার একটি সূত্র বলেছেন, এই দ্বিপক্ষীয় সফর আগেই নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু একটি গুঞ্জন ছিল যে, এই সফর কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে। কারণ, মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারত সফরে ছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এই শপথ অনুষ্ঠিত হয় ৯ই জুন। গত সাত বা আট দিনে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সফরের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। সূত্রটি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন যে, চীন সফরের আগে শেখ হাসিনাকে আতিথেয়তা দিয়ে বেইজিং যাত্রা কেড়ে নিতে চায় কিনা।
শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরের বিষয়টি দিল্লিতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় উঠেছিল কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে বিনয় খাত্রার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়। জবাবে তিনি বলেছেন, দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এবং তা কীভাবে সম্প্রসারিত করা যায় তা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। কোনো তৃতীয় দেশ নয়, কীভাবে চ্যালেঞ্জগুলো কমানো যায় দৃষ্টি দেয়া হয়েছিল তার ওপর। দুই প্রতিবেশী ও পুরো অঞ্চলের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে ছিল অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। দুই দেশই এ বিষয়গুলো আলোচনায় এনেছে। এই অর্জন পরিচালিত হবে সংযুক্তি, বাণিজ্য ও সহযোগিতা দ্বারা। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বড় ইস্যুগুলো আলোচনায় এসেছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও সংযুক্তি ছাড়াও ‘গ্রিন পার্টনারশিপ’, ডিজিটাল পার্টনারশিপ, ‘ব্লু ইকোনমি’ এবং মহাকাশ গবেষণায় সহযোগিতার সুযোগ সম্প্রসারণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে।
‘দিল্লি’স তিস্তা অফার টু স্কাটল চায়না অ্যাম্বিশন ইন বাংলাদেশ, ঢাকা ফোকাস অন ওয়াটার-শেয়ারিং’ শীর্ষক প্রতিবেদন অবলম্বনে/দৈনিক মানবজমিনের সৌজন্যে