বইয়ের কথা: ‘এলিস মুনরোর শ্রেষ্ঠগল্প’
‘এলিস মুনরোর শ্রেষ্ঠগল্প’ বইটিতে লেখকের প্রকাশিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সাতটি গল্পের অনুবাদ সূচিবদ্ধ করা হয়েছে। এ গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে লেখকের ভিন্ন ভিন্ন সফল নিরীক্ষার পরিচয় স্পষ্ট।
কানাডার অন্টারিওর উইংহ্যামে মুনরো ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তাঁর প্রকাশিত গল্প সংকলনগুলোর মধ্যে ডান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস্; সামথিং আই হ্যাভ বিন মিনিং টু টেল ইউ, দ্য বেগার মেইড, দ্য মুনস অব জুপিটার, দ্য প্রোগেস অব লাভ, ফ্রেন্ড অব মাই ইয়োথ, ওপেন সিক্রেকসট, সিলেকটেড স্টোরিজ, দ্য লাভ অব এ গুড ওম্যান, হেটসশিপ কোর্টশিপ লাভসশিপ ম্যরিজ উল্লেখযোগ্য।
প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড ওম্যান। এলিস মুনরো সাহিত্য কর্মে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৯ সালে ম্যানবুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এবং ২০১৩ সালে পেয়েছেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
মুনরোর গল্পে জীবনের এত নিবিড়তা পরিলক্ষিত হয় যে, তা অনেক সময় পাঠককে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়- আসলেই কি মানুষ এতটাই সংবেদনশীল? কিন্তু পাঠের গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে যখন চরিত্রগুলোর মনোজগতের উন্মোচন ঘটে, তখনই দেখা যায়, আসলে অবচেতনে মানুষ কতটা সংলগ্ন।
আমরা অনেক কাজই করি, ভেবেচিন্তে, হিসেব করে করি। কই তারপরও তো আমাদের ভুল হতে থাকে। ঠিকমতো ভালো কাজের ভালো ফলাফল কিংবা খারাপ কাজের খারাপ ফলাফল পাই না। অঙ্কের হিসেবের মতো জীবনের হিসেব মেলে না। কারণটা কি কখনও ভেবে দেখি? দেখি না। আর এই ভাবনা আর ভাবনার ফলাফল মানরো তার গল্পে যখন পরতে পরতে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, তখন আশ্চর্য হয়ে যাই। দেখতে পাই, আমাদের মনের গভীরেই কোথাও এর উত্তর লুকিয়ে ছিল।
মুনরোর গল্প আমাদের এই অর্ন্তচোখ খুলে দেয়। এক্ষেত্রে তিনি কখনও মনস্তত্ব, কখনও পারিপার্শ্বিকতা বা কখনও নিয়তির সাহায্য নিয়েছেন। আমরা যাকে দৈবিক বা অলৌকিক বলে ভাবি তা আসলে আমাদেরই অচেতন মনের ক্রিয়া। এই কঠিন ও পরীক্ষাসাধ্য মনস্তত্ব ও যুক্তিকে মানরো এমন অবলীলায় গল্পের আবেগের মধ্যে, গল্পের বুনটের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন, যে গল্প পড়ার পরে আর কোনও কিছু অলৌকিক মনে হয় না। চরম মন্দকেও নতুন চোখে দেখার, তার পারিপার্শ্বিকতা পরিপ্রেক্ষিতসহ দেখার একটা সহানুভূতিপ্রবণ মন গড়ে ওঠে পাঠকের মধ্যে। পাঠকের মধ্যে সহনশীলতা ও সংবেদনা তৈরির এই ক্ষমতাই মুনরোকে অন্য গল্পকারদের থেকে আলাদা করে তুলেছে।
কেন যেন মুনরোর গল্পে আলবেয়ার ক্যামু বা জাঁ পল সার্ত্রের মতো মনোদেশ তলিয়ে দেখার ও তাদের নির্লিপ্ত মনোভঙ্গী থেকে কয়েক কদম এগিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা আছে। সচেতন চেষ্টা আছে প্রান্তবর্তী মানুষের সমস্যা ও সমস্যার মধ্যেই খুঁজে খুঁজে নেওয়া সুখগুলোকে চিত্রায়নের। এভাবে এলিস মুনরো ব্যাপক হয়ে ওঠেন, বিস্তৃত হয়ে ওঠেন, সামগ্রিক হয়ে ওঠেন, ছোট পারিবারিক পরিবেশে গল্পের সূচনা করে সারা বিশ্বকে ধরে ফেলেন মুঠোর মধ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে একটা পরকীয়া পুরোপুরি শারীরিক আকর্ষণে তৈরি প্রেমের মধ্যে ভিয়েতনামের যুদ্ধ এসে পরে। জন্মদাগসহ জন্ম নেওয়া এক শিশুর তিতিক্ষার গল্পে এসে পরে হিটলার নাৎসি বাহিনী।
অথবা নিরেট অপত্য স্নেহের গল্পে কোথা থেকে ঢুকে পরে মানুষের অপরাধ প্রবণতার বিশাল জগতের সামগ্রিক চিত্র। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন মানুষ যে কখনও শেকড় বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, উন্মূল মানুষকে বাঁধতে চায় নিজের ছকে, আর ঘটতে থাকে সব অঘটন ও আত্মোপলব্ধি, আবেগের তীব্র অনুভূতির দাস মানুষ যে কখনওই ছকেবদ্ধ জীবনের দাসত্ব করতে পারে না, সব সম্ভাবনা সুখের প্রতিশ্রুতি থাকলেও যে পরিবেশ প্রতিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশ থেকে যে তাকে পৃথক করা যায় না, বরং অনেক বেশি জ্ঞান ও পরিচর্যা পেলে ওই শেকড়ে যাবার আবেগই মানুষের মনকে টানে সে গল্প মানরো আমাদের শুনিয়েছেন আর আমরাও দমবন্ধ করা অনুভূতি নিয়ে সে গল্প শুনতে থাকি, আবিষ্কার করতে থাকি ভেতরের আমিকে। মুনরো আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়ে দেখতে সাহায্য করতে থাকেন আমাদের ভেতরের আমিকে, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া সব বিষয়ের গ্রহণযোগ্য কার্যকারণকে।
শুধু গল্প বলে আত্মোপলব্ধির জাগরণ ঘটানো, তাও আবার সুখপাঠ্য গল্প বলে, সহজ কথা নয়। মানরো এই কঠিন কাজটি সহজ ভাবে করেন। তার শিল্পকৌশল এক্ষেত্রে সহায়তা করে তাঁকে। প্রতিটি খুটিনাটি তিনি উল্লেখ করেন সাবলীলভাবে যা থেকে পাঠক পেয়ে যান তৃপ্তি, কিন্তু এর মধ্যেই কৌশলে তীব্র আলো ফেলেন মনোজগতে।
অনুবাদের ক্ষেত্রে এই আলোকে ঠিকভাবে ভাষান্তর করা হলেই স্পর্শ করা সম্ভব হয় গল্পের হৃদস্পন্দন। এ গ্রন্থে অনূদিত প্রতিটি গল্পে অনুবাদক বিপাশা মন্ডল প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন গল্পের সেই হৃদস্পন্দনটি ধরে রাখতে। অনুবাদের সময় একটি শব্দ একটি বর্ণ বা একটি মনোভাব অথবা গল্পের পিছনের গল্পও বাদ দেন নি বিপাশা। কারণ ২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাবার পরে কয়েক লেখক বন্ধুর মানরোর বিষয়ে বিদ্বেষসূচক কথায় প্রভাবিত হয়ে সংগৃহীত বইগুলো আর দেখাই হয় নি। কিন্তু হঠাৎ করেই এক বছর আগে, ওই বইগুলো তুলে রাখবার আগে একবার দেখতে গিয়ে, পড়তে গিয়ে চমকে ওঠেন বিপাশা, কোন গল্পে তিনি বলেন নি মানুষের কথা জীবনের কথা বা প্রান্তবর্তী মানবাত্মার উপলব্ধির কথা।
জীবনকে নতুন চোখে গভীরতর উপলব্ধির চোখে দেখতে হলে এলিস মুনরোর গল্প হতে পারে পথপ্রর্দশক, কারণ পাঠক খুব সহজে তাঁর কথা বুঝতে পারেন। এরকমটা ভেবে লেখাগুলো থেকে এই সাতটি গল্প বাছাই করেছেন অনুবাদক বিপাশা মন্ডল। শিরোনাম দিয়েছেন ‘এলিস মুনরোর শ্রেষ্ঠ গল্প।’ কেননা তিনি জানেন, পাশ্চাত্যের সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ বলে কিছুকেই চিহ্নিত করা হয় না। কিন্তু এ গ্রন্থে অনূদিত গল্পগুলো শ্রেষ্ঠ এ কারণে যে প্রতিটি গল্প আলাদা স্বাদের। তৃপ্তিদায়ক। চিন্তা-জাগানিয়া। সম্পূর্ণ। ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার প্রতিনিধিত্বকারী। জনবিরল কানাডার পটভূমিতে লেখা এ গল্পগুলো ভালোবাসার কোলাহলে পরিপূর্ণ। অনুবাদ সাহিত্যে ইতোমধ্যেই মুন্সিয়ানায় নিজেকে সফলভাবে পরিচিত করে তোলা বিপাশা মন্ডলের আরেকটি পরিশ্রমের ফসল ‘এলিস মুনরোর শ্রেষ্ঠগল্প।’ দীর্ঘ পুরো একটি বছর ধরে অনুবাদ করা এ বইটি বিপাশার ত্রিশোর্ধ অনুবাদকর্মের মতো এটিও নিঃসন্দেহে পাঠকের ভালো লাগাকে জয় করবে।