যাত্রাপালার বিকল্প ‘ডিজিটাল ওয়াজ’, বলেন ঠিক কি না?
দিন বদলের মতো বাংলাদেশের কৌতুকও বদলে গেছে। দু-একটা উদাহরণ দিলে বিলকুল বোঝা যাবে–
প্রথম কৌতুক
বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে এক লোককে। তার শরীরে এইডসের জীবাণু পাওয়া গেছে! পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইল। লোকটি বলল– ভাই আমারে ডাক্তারের কাছে না নিয়া দয়া কইরা ইব্রাহিম সাহেবের জিম্মায় দিয়া দেন। পুলিশের একজন জানতে চাইল– ইব্রাহীম মেমোরিয়াল হাসপাতাল মানে বারডেম? আপনার কি ডায়াবেটিসও আছে? লোকটি বলল– না স্যার। এই ইব্রাহিম ডাক্তারদের চাইয়াও বড়। অ্যান্টারকোটিক মহাদেশের আবিষ্কারক! হে বুঝবে আমার এইডসের জীবাণু লম্বা না গোল!
দ্বিতীয় কৌতুক
রাতের বেলা এক লোক উদভ্রান্তের মতো ঠিকানা খুঁজছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞাসা করছে– ভাই এই ঠিকানাটা খুঁজছি। একটু দেখিয়ে দেন না! পুলিশ লোকটার পথ আটকাল। জানতে চাইল– আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কার ঠিকানা খুঁজছেন এভাবে? লোকটি ঠিকানা লেখা কাগজটা পুলিশের একজনের হাতে দিয়ে বলল– আমি তারেক হুজুরের ঠিকানা খুঁজছি। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। হেলিকপ্টারে চড়ে আমার বরযাত্রা করার কথা। কিন্তু আমার হবু বউ বলেছে হেলিকপ্টার নাকি এখন অস্বাস্থ্যকর বাহন। তারেক হুজুররে বইলা আমাকে রকেট ভাড়া নিতে বলল। রকেট না পাইলে আমার বরযাত্রা হবে না ভাই!
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বহুদিন পর বাংলাদেশে নামকরা কয়েকজন বিজ্ঞানী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী এবং শিক্ষাবিদের আবির্ভাব ঘটেছে যারা ধর্মকে ‘জোকারি বা স্ট্যান্ডআপ কমেডি’র সাথে ব্লেন্ড করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মেতে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে দেশবাসী সম্ভবত এদের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। নাগরিক জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝে এদের জোকারি অনেকের কাছে অভিনব মনে হয়েছে! কারও কারও মতে, তাদের এই জোকারি প্রচলিত বিনোদনের ধরনকেও বদলে দিয়েছে। ইদানিং দেশের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ওয়াজ!
কেউ কেউ বলছেন এসময়ের ওয়াজ টেলিভিশনের টক শো, কমেডি শো এমনকি যাত্রাপালার বিকল্প হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। টেলিভিশনের টক শো, কমেডি শো কিংবা যাত্রাপালার সাথে ছওয়াব কামানোর ব্যাপারটা থাকে না কিন্তু ওয়াজের সাথে থাকে। তাই চেতন অবচেতনে বিশ্বাসী মানুষেরা এই ‘ডিজিটাল ওয়াজে’র জগতে পা বাড়ায়। ওয়াজ শুনে প্রান্তিক মানুষদের কেউ কেউ বিশ্বাসও করতে শুরু করেছেন– বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আসল নাম এসহাক নিউটন যিনি আসলে একজন ‘বিজ্ঞান চোর!’ নিউটনের মতো আইনস্টাইনও নাকি তার আবিষ্কার মুসলমানদের কাছ থেকে চুরি করেছেন! হেলিকপ্টার একটা অস্বাস্থ্যকর বাহন তবে রকেটে চড়া কোনও ব্যাপারই না!। অক্সফোর্ড বছর বছর এদেশের একজনকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদা দেয়, নাসা () বার বার ওনাকে ডেকে নিয়ে যায়! এইডসের জীবাণু গোল হয়, লম্বা কেন হয় না– এই থিওরির আবিষ্কারক একজন বাংলাদেশি! বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে এক এক করে কয়েকজন কীর্তিমানের ঘটনা শুনুন–
এক.
প্রথমজনের নাম মুফতি ইব্রাহিম। ভদ্রলোকের সেরা আবিষ্কার অ্যান্টারকোটিক মহাদেশ। ভদ্রলোকের মতে– পৃথিবীর ভেতর আরেক পৃথিবী আছে যার নাম অ্যান্টারকোটিক। সেখানে পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর আকাশ সব আছে! হিটলার পলায়ন করেন নি বা আত্মহত্যা করেন নি। তার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত, কামান-বন্দুক নিয়া হিটলার সেখানে গেছেন! ওনার ওয়াজ শুনে লক্ষ মানুষ ইব্রাহিম সাহেবের নেতৃত্বে অ্যান্টারকোটিকে যাবার বাসনা পোষণ করেছেন। ভদ্রলোক আরও দাবি করেছেন– এইডসের জীবাণু গোল। জীবাণু লম্বা কেন না সেই বিষয়ে তিনি পড়ালেখা করেছেন। ভদ্রলোক জোর দিয়ে বলেছেন– আইজ্যাক নিউটনের আসল নাম এসহাক নিউটন। ভদ্রলোক নাকি মুসলিম বিজ্ঞানীদের ছাত্র ছিলেন। নিউটন খোদাভক্ত ছিলেন, মুসলমানদের নিয়ে নাকি অনেক কিছু লিখে গিয়েছেন যা নাকি তার জীবদ্দশায় প্রকাশ করলে মেরে ফেলা হতো নিউটনকে! বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, গ্যালিলিও নাকি চোর। সব আবিষ্কার মুসলমানদের! এরা নাকি শুধু নিজের নামে সেসব চালিয়ে দিয়েছেন। কলম্বাসও নাকি অ্যামেরিকা আবিষ্কার করেন নি! এত্তোসব বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের জন্য নিদেন পক্ষে অ্যান্টারকোটিক আবিষ্কারের জন্য ইব্রাহিম সাহেবকে জাতীয় পদক, নোবেল, অস্কারসহ যত পুরস্কার আছে সবগুলো দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। তবে ওয়াজে সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা তত্ত্ব, তথ্য দেওয়ার জন্য অনেকে তার মস্তিষ্ক এবং জিহ্বা জাদুঘরে রাখার দাবি জানিয়েছেন।
দুই.
আরেক ভদ্রলোকের নাম তারেক মনোয়ার। ১৯৯০ সালে উনার বয়স ছিল বার থেকে পনের। তখনই উনি নাকি ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে টাকার বিনিময়ে খেলতেন। কোন টিমে খেলেছেন তা অবশ্য ভদ্রলোক বলেন নি। উনি নাকি ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নও ছিলেন। (পরে অবশ্য বলেছেন উনি পাড়ার একটা টুর্নামেন্টে ব্যাডমিন্টন খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।) এখন বলেন– ইসলামে খেলাধুলা হারাম! যারা ‘মোচ’ (গোঁফ) রাখে তারা নাকি বেয়াদব। (দুনিয়ার সকল মোচওয়ালা এক হও!) ওয়াজে উনি মিনারেল ওয়াটার দেখিয়ে বলেন– মিনারেল ওয়াটার খেলে নাকি ক্যান্সার হয়! অথচ প্রত্যেক ওয়াজে তারেক সাহেবকে মিনারেল ওয়াটার পান করতে দেখা যায়। ওয়াজে উনি গর্ব করে বলেছেন– নিজের বউ বাচ্চাকেও বলেন নি যে অক্সফোর্ড থেকে উনি তিন-তিনবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। বিল গেটস (ওনার উচ্চারণে এটা বেল গ্রেড। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী ও আইফোনের মালিক) কয়েকবার নাকি তারেক মনোয়ার সাহেবকে ফোন করেছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তারেক সাহেব নাকি তার ডাকে সাড়া দেন নি! একারণে তাকে বলা যায় বাপের বেটা। ময়দানে থাকলে আওয়াজ দেন– ঠিক কিনা!
২০১৫ সালে নাকি অ্যামেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প উনাকে হোয়াইট হাউসে নিমন্ত্রণ জানান এবং উনি নাকি ট্রাম্পের সাথে দেখা করতে যান নি (এটারও কোন প্রমাণ দিতে পারেননি ভদ্রলোক! তারেক সাহেব অবশ্য জানেন না, যে ২০১৫ সালে ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউজে এসেছিলেন কি না।) তারেক মনোয়ার সাহেব গর্ব করে বলেন– ‘হেলিকপ্টার অস্বাস্থ্যকর বাহন আমি রকেটেও চড়েছি’! নাসাতেও নাকি তারেক মনোয়ার কয়েকবার ভিজিট করেছেন। সূর্য নাকি পশ্চিমেও উঠতে পারে যখন তখন! উনি অবশ্য কোনটারই কোনও প্রমাণ দিতে পারেন নি। ইংরেজি নিয়েও ভদ্রলোকের গবেষণা আছে। ইংরেজি নাকি ‘পোরেস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ (উনি কী গরীবতম ভাষা বোঝাতে চেয়েছেন? তাহলে দু এক লাইন যে ইংরেজি বলেন সেটা বাদ দিলেইতো পারেন)! হাউজ ওয়াইফ মানে ঘরের বউ! এটা নাকি ভুল। এরচেয়ে ভালো ইংরেজি শব্দ নাকি ‘বেটার হাফ”। ইসলামের শুদ্ধির জন্য এই ভদ্রলোককে ‘বেটার লিভ’ করা উচিত! নির্জলা মিথ্যাচার ও মুর্খতা দিয়ে ইসলাম প্রচার করা সম্ভব না। সত্য মিথ্যা নির্ণীত নয় তবু অনেকে বলে থাকেন এই ভদ্রলোক ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে গুজবের অন্যতম রূপকার’। স্বপ্নে কবি কাজী নজরুল তার কাছে এখনও আসে! ভদ্রলোক উসকানি দিয়ে বলেন– ইসলামের স্বার্থে হত্যার কাজটাও শিখতে হবে!
তিন.
আরেক ভদ্রলোকের নাম আমীর হামজা। ভদ্রলোক কথায় কথায় বলেন– ‘আমি ইউনিভার্সিটির মাল’। ভারতীয় টেলিভিশনে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর গল্প বলে প্রমাণ করতে চান– মেয়েরা খুব কমই বেহেশতে যাবে। কথায় কথায় মেয়েদের ছোট করেন। বলেন উল্টাপাল্টা ড্রেস পরে মেয়েরা রিক্সা কিংবা গাড়িতে উঠলে রিক্সা বা গাড়ির চালক তো অ্যাকসিডেন্ট করবেই! ভদ্রলোক সবাইকে ১৪ ফেব্রুযারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করতে বলেন, তবে সেটা বিয়ের পরে! ওয়াজে মাহফিলে আওয়াজ তোলেন– ময়দানে আছেন? আপনি মানুষ নাকি কলেরা? আওয়ামী লীগের অনেকে নাকি তার বংশের লোক। ওয়াজকে কমেডি বা ফানের পর্যায়ে নিয়ে আসার প্রথম দিকের রূপকার এই হামজা সাহেব। তবে অন্য দুই একজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারও করেন ওয়াজে। যেমন– গিয়াসউদ্দীন তাহেরী!
চার.
সংগীত নির্ভর আরেক মাওলানার নাম গিয়াসউদ্দীন তাহেরী। উনি আবার ইমানি বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা যিনি কি না নরসিংদীর রায়পুরায় খাজা বাবার নামে একটা আখড়া খুলেছেন। ভদ্রলোকের হিট ডায়ালগ হচ্ছে– চা খাবেন? ঢেলে দেব? কেউ কেউ ভদ্রলোকের নাম রেখেছেন– বসেন হুজুর! ভদ্রলোকের গানের লাইন– ‘বসেন বসেন। বসে যান। বসেন বসেন বইস্যা যান’। জিকিরের সাথে সাথে তার এই গানের পরিবেশনা না দেখলে আপনি ‘ব্যাপক বিনোদন’ মিস করতে পারেন। উনি মাঝে মাঝে বলেন– নাউজুবিল্লাহ পকেটে রাইখ্যা দেন। তাহেরী গানের পরিবেশনার মাঝে মাঝে অন্য ওয়াজকারীকে আক্রমণ করতেও ভোলেন না। যেমন– মিজানুর রহমান আজহারি।
পাঁচ.
ওয়াজকারীদের ভেতর আরেক ‘রাজাকার চরিত্র’ মিজানুর রহমান আজহারী। তিনি গান পরিবেশন করেন কিন্তু ওয়াজের ভেতর সুযোগ পেলেই দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর কথা বলেন। চিৎকার করে বলেন– ‘এক আল্লামা কারাগারে লক্ষ আল্লামা এখন ঘরে ঘরে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত সাইদীর জন্য আজহারী সাব আহাজারি করতে করতে চোখের জল ফেলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দেন সাইদীকে শাস্তি দেবার জন্য খেসারত দিতে হবে। ওয়াজের কারণে জনপ্রিয় হয়ে সাইদী যেমন তার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামের কাজে, আজহারীও সম্ভবত সেইদিকে হাঁটছেন। সাইদী ওয়াজে বলত– ‘নারী নেতৃত্ব হারাম, যে জনগণ দেশের নেতৃত্বের জন্য মহিলাদের বেছে নেয় তাদের ওপর ‘লানত’ বর্ষিত হয়।’
আজহারী প্রায় সব ওয়াজে এই কথা বলে থাকেন। আজহারী যে সমস্ত গান করেন ওয়াজ করতে এসে– সেগুলোর কয়েকটা এমন– ‘আমরা হগ্গল সিলেটি’, ‘পোলাতো নয় যেন আগুনেরই গোলারে’ কিংবা গুরু ‘ঘর বানাইলা কী দিয়ারে’ আদলে ‘গুরু গাঞ্জা বানাইলা কী দিয়া’…
যাত্রাপালায় যেমন নাচ গান ভ্যারাইটি শো-ও থাকে ‘ওয়াজ’ এখন তেমনভাবে পরিবেশন করছে এরা। কেউ জিকির ও গানের তালে তালে নাচেন, কেউ গানের সাথে বাউলের মতো মাথা ঝাকান, কেউ কেউ অন্য ওয়াজকারীকে তুমুল গালাগাল করেন। ‘তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ কিংবা ‘সেরাকণ্ঠ’ শিরোনামে যেমন গান নিয়ে রিয়েলিটি শো হয় এবং সেরা গায়ক গায়িকা নির্বাচিত করা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওয়াজ দেখেও তেমনি সেরা পাঁচজনকে নির্বাচিত করেছেন কেউ কেউ।
এরা হলেন (উল্টা দিক থেকে)
৫. নাজমুল ইসলাম মুজাহেদী। তার পরিবেশিত গান– ‘মাঝি বাইয়া যাও রে, অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে’! ওয়াজের ভেতর উম্মাদনা বা ছোবল তুলনামূলক কম।
৪. ‘মধু খই খই বিষ খাওয়াইলা’ গান দিয়ে টপ সেভেনে পাকাপাকি করে নিয়েছেন ক্বারী আমানুল্লাহ। ভদ্রলোক মেয়েদের নিয়েও কম যান না। তাদের দাবিয়ে রাখার বিভিন্ন কথা বলে জানতে চান– ‘আমি কী পুরুষ মানুষ না’?
৩. ‘নিশি রাইতে কার বাঁশি বাজে’ কিংবা ‘বসেন বসে যান’ গান নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছেন ‘চা খাবেন ঢেলে দেব’ খ্যাত গিয়াসউদ্দীন তাহেরী! উম্মাদনা কিংবা অন্ধকারের দিকে যাত্রার ছোবল বেশ ভালো তাহেরীর।
২. দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছেন মাওলানা ইলিয়াসুর রহমান জিহাদী। তার উপস্থাপন করা ‘ওহ ললনা’ গানের ভিউ নাকি পাঁচ কোটি। এই ভদ্রলোককে কেউ কেউ এই গানের প্রযোজকও বানিয়ে ছেড়েছেন।
১. এখনও শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছেন মাওলানা গোলাম রাব্বানী। ওয়াজ মাহফিলে উনি যেসব গান করেন তা হচ্ছে– ‘সব সখিরে পার করিতে নিব আনায় আনা’, ‘তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই, আর কিছু পাই..’
নাম উল্লেখকৃত ওয়াজকারীদের চরিত্র প্রায় এক। নারী নেতৃত্ব ও নারীদের নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এবং বিষোদগার। অন্য ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা ও ছোট করার প্রবণতা লক্ষণীয় যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। সাধারণ প্রান্তিক মানুষের ভেতর তিল তিল করে এরা ছড়িয়ে দেয় নারী বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা। মোটাদাগের অশ্লীল এই উপস্থাপন ওয়াজের নামে শুরু করেছিলেন যুদ্ধাপরাধী সাইদী নিজেই। ‘আলিফ খালি বে এর নিচে এক নখতা’র মতো দেখবেন, এই যুগের নারীর বুক খালি পেট খালি কপালের ওপর এক নখতা নাভির নিচে’… সাইদীর এমন ওয়াজ ভোলেন নি অনেকে। নিশ্চয় ভোলেন নি মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদানের জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন। নিকৃষ্ট সাইদী শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ওয়াজের মধ্যে বলতেন– ‘জাহান্নামের ইমাম’! রাস্তায় যৌন উত্তেজক ওষুধ এর বিক্রেতা বা ক্যানভাসারদের মতোই সাইদী বা একালের অনেকের ওয়াজ আজও দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই ওয়াজকারীরা উসকানি দিয়ে বলে– ‘রবীন্দ্রনাথ কাফের কাজেই জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে, চাপিয়ে দেয়া যাবে না’!
এরা বলে– ‘মূর্তিভাঙ্গা ধর্মীয় কাজ’; ‘আল্লাহ রসুলকে গালি দিলে কোপাতে হবে’; এরা বলে– ‘শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হারাম’; ‘গণতন্ত্র ইসলামে খাটে না!’; এরা বলে– ‘নববর্ষ পালন করা হারাম’। এরা নাটক সিনেমার নায়ক নায়িকাদের গালাগাল করে বলে ‘লুচ্চা’। সঙ্গীত শিল্পীদের বলে ‘খবিশ’!
বিদেশি জনপ্রিয় একটি সংবাদ মাধ্যম এবং বাংলাদেশের একাধিক টেলিভিশন ও পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সনে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৫ জনের ওয়াজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অনতিবিলম্বে এই তালিকার সাথে আরও কিছু ‘দেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর’ নাম যুক্ত করে এদের প্রতিহত করা উচিত।
না হলে এরাই দেশটাকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিংবা নাইজেরিয়া বানিয়ে ছাড়বে!
লেখক: রম্য লেখক, নাট্যকার ও কলামিস্ট। হেড অব প্রোগ্রাম, বৈশাখী টেলিভিশন।