যেভাবে মাত্র ১১ দিনে ধসে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের ৪ ব্যাংক
মাত্র ১১ দিনে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ধসে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপভিত্তিক ৪টি বৃহৎ ব্যাংক, এবং অপর আরেকটি ব্যাংক আছে টলমাটাল অবস্থায়। যে কোনো সময় একই পরিণতি নেমে আসবে পঞ্চম ব্যাংকটির ক্ষেত্রেও।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ব্যাংকগুলোর ধসের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ও গ্রাহক। সংকটের জের এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু এই বিপর্যয়ের কেমন করে ঘটেছিল এবং কর্তৃপক্ষ কীভাবে তার সামাল দিচ্ছে, তা নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
সিলভারগেট ব্যাংক
গত ১১ দিনের ‘ঝড়ে’ প্রথম যে ব্যাংকটির পতন হয়েছিল, তার নাম সিলভারগেট ক্যাপিটাল করপোরেশন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিপ্টো কারেন্সি শিল্পের মন্দাভাব ব্যাংকটি পতনের জন্য প্রধানত দায়ী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফেডরেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন যদি সরকারি নির্দেশ মেনে ঠিক সময়ে উদ্যোগী না হতো, তাহলে চুড়ান্তভাবে ধসে পড়ত সিলভারগেট ব্যাংক।
মার্কিন ক্রিপ্টো জায়ান্ট এফটিএক্স এবং আলামেডা রিসার্চের সঙ্গে সিলভারগেট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আর্থিক লেনদেনে কোনো দুর্নীতি হয়েছিল কিনা—খতিয়ে দেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগ। তবে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ক্রিপ্টো কারেন্সির সাম্প্রতিক মন্দাভাবই মূলত ব্যাংকটির পতনের জন্য দায়ী।
গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের টাকা ফিরিয়ে দিতে নিজেদের সব সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে গত ৪ মার্চ নিজেদের যাবতীয় কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে সিলভারগেট ক্যাপিটাল কর্পোরেশন।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক
সিলভারগেট ব্যাংকের পতনের রেশ কেটে যাওয়ার আগেই ধসে পড়ে দেশটির ষোলতম বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক সিলিকিন ভ্যালি (এসভিবি)। তবে এই ব্যাংকটির পতনের মূল কারণ গুজব।
গত ৮ মার্চ এনভিবি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়— কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের ২২৫ কোটি ডলার মূল্যমানের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সংবাদ প্রচারের পরপরই গুজব ছড়িয়ে পড়ে— সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক তহবিল সংকটে ভুগছে এবং এ কারণেই শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটি।
গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এনভিবি থেকে সমানে নিজেদের টাকা তুলে নেওয়া শুরু করেন, শেয়ারের দামও পড়তে থাকে হু হু করে। ফলে মাত্র দু’দিনের মধ্যে তহবিলশূন্য হয়ে নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় এসভিবি।
সিগনেচার ব্যাংক
এসভিবি ব্যাংকের পতনের মাত্র দু’দিনের মধ্যে, ১২ মার্চ ধসে পরে মার্কিন ব্যাংক সিগনেচার। যে কারণে এসভিবির ধসে পড়েছিল, সেই একই কারণে অর্থাৎ বাজারে ছড়িয়ে পড়া গুজবের জেরে পতন ঘটেছে সিগনেচার ব্যাংকের। গুজব ছড়িয়েছিল— এসভিবির মতো সিগনেচার ব্যাংকও গুরুতর তহবিল সংকটে ভুগছে। ফলে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের সবাই ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেন এবং একসময় যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সিগনেচার ব্যাংকের পতনের কারণ হিসেবে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসভিবির ধসের পর গ্রাহকদের মধ্যে সৃষ্ট আস্থার সংকটই ব্যাংকটির এ পরিণতির জন্য দায়ী
বন্ধ হয়ে যাওয়া সিগনেচার ব্যাংকটি ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে রোববার কিনে নিয়েছে নিউইয়র্কের বৃহত্তম ব্যাংক ফ্ল্যাগস্টার। এই অর্থের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার নগদ দেবে ব্যাংকটি, বাকি ১ হাজার ৩০০ ডলার কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে ব্যাংকটির সঞ্চিত আমানতের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার এবং এটির দায় বর্তমানে ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
ক্রেডিট সুইস
সুইজারল্যান্ডের ১৬৬ বছরের পুরোনো ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের পতন ঘটেছে ঋণ লেনদেনে বড় ধরনের একাধিক কেলেঙ্কারি, আর্থিক লোকসান এবং ব্যাংকটি থেকে ব্যাপকহারে গ্রাহকদের টাকা তুলে নেওয়া। ক্রেডিট সুইসের শীর্ষ নির্বাহী উলরিচ কোরনার ব্যাংকটিকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু ধস ঠেকানো যায়নি।
গত ৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউএস সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ব্যাংকটির বাৎরিক রিপোর্টের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার পর ব্যাংকের বিদেশি গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের অর্থ তুলে নিতে শুরু করেন এবং ব্যাংকটির পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কয়েকদিন আগে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইউবিএস গ্রুপ এজি ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে ব্যাংকটি কিনে নিয়েছে।
ক্রেডিট সুইসের পতনকে ইউরোপের ব্যাংকিং খাতে একটি বড় ধাক্কা বলে উল্লেখ করেছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কারণ পুরোনো এই ব্যাংকটির পতনের পর থেকে ইউরোপের সব ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমে গেছে।
ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক
গ্রাহকরা ব্যাপকহারে সঞ্চিত অর্থ তুলে নেওয়ায় ডুবে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকও। গত কয়েক দিনে ব্যাংকটি থেকে গ্রাহকরা তুলে নিয়েছেন ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটিকে সচল রাখতে ৩ হাজার ডলার নগদ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহর ভিত্তিক এই ব্যাংকটি শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা— তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ এখনও আছে।