রক্ষকই যখন ভক্ষক
জনগণের পাশে দাঁড়ানো ও আইন প্রণয়নের জন্য নিয়োজিত হলেও সম্প্রতি শিক্ষক ও দলীয় কর্মীদের মারধর এবং সরকারি কর্মকর্তাকে হুমকি ও গালিগালাজের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য। আইনপ্রণেতা হয়েও তারা নিজেরাই হাতে তুলে নিয়েছেন আইন।
তাদের উচ্ছৃঙ্খল ও আগ্রাসী আচরণে দলের অভ্যন্তরেও সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ। এ ঘটনাগুলোয় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পাশাপাশি তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
এমপিরা সীমা অতিক্রম করেছেন, এমন ছয়টি ঘটনার তথ্য দ্য ডেইলি স্টারের কাছে আছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রাজি মোহাম্মদ ফখরুল।
গত শনিবার কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের এই আইনপ্রণেতা জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এক সভা চলাকালে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে ঘুষি ও লাথি মারেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা দলের অভ্যন্তরেও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বৈঠকে উপস্থিত কুমিল্লার ৩ আওয়ামী লীগ নেতা রওশন আলী মাস্টার, একেএম শফিকুল আলম ও মেহেদী হাসান ডেইলি স্টারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তাদের অভিযোগ, দেবিদ্বার উপজেলার অন্তর্গত এলাহাবাদ ইউনিয়নের দলীয় কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আবুল কালামকে প্রকাশ্যে মারধর করেন ফখরুল।
কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রওশন আলী বলেন, ‘যখন এলাহাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন আবুল কালাম ওই কমিটিকে সমর্থন করায় এমপি ফখরুল ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।’
ঘটনার সময় এমপির কাছেই বসে ছিলেন কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য মেহেদী। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তিনি (ফখরুল) আবুল কালামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার পা, ঘাড়, নাক ও মাথায় বারবার লাথি ও ঘুষি মারতে থাকেন।’
এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও বলেন, কয়েকজন আইনপ্রণেতার ভুল কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল এবং এর অনেক সংসদ সদস্য “বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে” জড়িত। তবে দলের কোনো নেতা—এমপি বা যে কেউ হোক না কেন, যদি অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’
মন্ত্রিসভার এই জ্যেষ্ঠ সদস্য আরও বলেন, ‘ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় আমরা বিবেচনা করব না যে তিনি এমপি বা দলের কোনো পদে আছেন কি না।’
রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধরের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কেউ যদি আইন লঙ্ঘন করে, সে যেই হোক না কেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর ডাকা সংবাদ সম্মেলনে মারধরের ঘটনাটি অস্বীকার করলেও তদন্ত কমিটির কাছে তা স্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ সেলিম রেজা।
সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড অত্যন্ত আপত্তিকর। এটা অত্যন্ত জঘন্য কাজ। এ ধরনের কাজের সমালোচনা করার মতো শব্দও আমার কাছে নেই…।’
‘এমপিরা দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তারা আইনপ্রণেতা। একজন সংসদ সদস্য কীভাবে একজন শিক্ষককে মারধর ও লাঞ্ছিত করতে পারেন?’, যোগ করেন তিনি।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপিরা অন্ধ হয়ে গেছেন উল্লেখ করে এই জাপা নেতা আরও বলেন, ‘তারা এখন আর মানুষের কথা ভাবে না… ।’
সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নাদিরা ইয়াসমিন জলির আরেকটি ঘটনাতেও সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র তার কাছে দেরিতে পৌঁছানোয় গত ৮ মার্চ পাবনার এই সংসদ সদস্য জেলার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে চড় মারার হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অন্তত মানুষকে মারধরের ক্ষেত্রে বরগুনা-২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শওকত হাসানুর রহমান রিমন কোনো ধরনের বৈষম্য রাখেননি।
রিমন বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা, একজন সরকারি কর্মচারী ও স্থানীয় যুবককে মারধর এবং এক নারী আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ কর্মীকে লাঞ্ছিত করেছেন।
ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানার সঙ্গে টেলিফোনে গালিগালাজ করেন এবং ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারকে ‘উপযুক্ত জবাব’ দেওয়ার হুমকি দেন।
২০২০ সালের ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপ-নির্বাচনের দিন নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে ভাঙ্গার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিক্সনের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করার পর এমপি এ কাজ করেন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের এ ধরনের আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশের এ ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব-জনিত উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নতুন কিছু নয়। যদিও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিষ্ঠুরতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।’
‘আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের যারা গণতন্ত্র, মূল্যবোধ ও রাজনীতির সঠিক চর্চা বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য এসব ঘটনা অত্যন্ত বিব্রতকর’, বলেন তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘বর্তমান এই পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে চলতে থাকলে তা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যতের জন্য অশুভ।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এমপিরা অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে জড়িত হচ্ছেন, যা আইনপ্রণেতা হিসেবে তাদের কখনোই করা উচিত নয়।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা কলেজের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। যারা তাদের এই অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে প্রতিবাদ করছেন, তারাই পরবর্তীতে ওই এমপিদের ক্রোধের শিকার হচ্ছেন।’
এই ধরনের নেতৃত্ব ভিন্নমতাবলম্বী মতামত সহ্য করতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি অসংস্কৃত ও অসহিষ্ণু নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে ভুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কারণ বিরোধীরা সাংবাদিকদের ভুল তথ্য দেয়।’
‘তবে, পুরো সমাজই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এবং মানুষ অতিসাধারণ বিষয়েও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর সংসদ সদস্যসহ কোনো নেতা যদি বেআইনি ও অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, তাহলে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে’, বলেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারের সৌজন্যে।