রনিলকে তাড়ানোর ঘোষণা বিক্ষোভকারীদের
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে তাতে দ্বীপদেশটিতে চলমান সংকটের সমাধান হচ্ছে না। রাজাপক্ষেদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে রাজপথে নামা বিক্ষোভকারীরা এখন রনিলকেও তাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
গতকাল বুধবার পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর মোট ভোটের চেয়ে ৪৯ ভোট বেশি পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। এর মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় বিভক্তির অবসান হওয়ার কথা বলেছেন তিনি। পার্লামেন্টে দেওয়া বিজয়ী ভাষণে রনিল বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে এখন আর কোনো বিভক্তি নেই।’ তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নেওয়া মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আন্দোলন এখন শেষ হয়েছে। গলে ফেস-এ বিক্ষোভকারী তরুণদের এখন এটা বুঝতে হবে। তাঁদের এখন সেখান থেকে চলে যেতে হবে এবং নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে হবে।’
তবে গত নির্বাচনে একটি আসনেও জয়ী হতে না–পারা রনিল বিক্রমাসিংহের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াকে গণতন্ত্রের মুখে চপেটাঘাত হিসেবে দেখছেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
শ্রীলঙ্কার আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট ইউনিয়নের (আইইউএসইউএসএল) আহ্বায়ক ওয়াসান্থা মুদালিগে সাংবাদিকদের বলেন, ‘রনিল রাজাপক্ষেদের কর্মচারী।
এই সরকার যদি মনে করে যে বুলেট বা কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে আমাদের চুপ করানো যাবে, তাহলে তারা ভুল করবে। রনিল বিক্রমাসিংহেকে বাড়ি পাঠানোর আগপর্যন্ত আমরা কোনো চেষ্টা বাদ রাখব না। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নন। আমরা একজন প্রেসিডেন্টকে তাড়িয়েছি। তাঁকেও তাড়াব। দেখেন সামনে কী হয়।’
বিক্ষোভের মুখে গত মে মাসে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এরপর সংসদে মাত্র একটি আসন থাকা ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসান মাহিন্দার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তাতে জনরোষ কমে নি। তুমুল বিক্ষোভের মুখে গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে প্রথমে মালদ্বীপ ও পরে সিঙ্গাপুরে যান গোতাবায়া।
সেখান থেকে ১৪ জুলাই পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। এরপর সংবিধান অনুসারে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন রনিল বিক্রমাসিংহে। গত সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা যখন গোতাবায়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দখল নেন, সে সময় রনিলের ব্যক্তিগত বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
গত এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভের সূচনা হয়। তখন থেকে এই আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসছেন স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নেতা–কর্মীরা। এই ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বামপন্থী দল ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির (এফএসপি) সম্পর্ক রয়েছে। এ দলের নেতা কুমার গুনারত্নে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে রাজাপক্ষেদের কবল ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত তিনি লড়াই থামাবেন না।
রনিল বিক্রমাসিংহের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াকে জনগণের প্রত্যাশাবিরোধী আখ্যায়িত করেছেন আরেক বামপন্থী দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা হরিনি অমরাসুরিয়া। এই পার্লামেন্ট সদস্য এক টুইটে লিখেছেন, আরও একবার পার্লামেন্ট দেশের জনগণের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলো। এখন পার্লামেন্ট বিলুপ্তি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেভিপির প্রার্থী অনূঢ়া কুমারা দিসানায়েকে পেয়েছেন মাত্র ৩ ভোট। রনিল বিক্রমাসিংহে পেয়েছেন ১৩৪ ভোট। অপর প্রার্থী ক্ষমতাসীন শ্রীলঙ্কান পদুজনা পেরামুনা পার্টির (এসএলপিপি) ভিন্নমতাবলম্বী নেতা দুলাস আলহাপেরুমা পেয়েছেন ৮২ ভোট। দুজন এমপি ভোটদানে বিরত ছিলেন।
শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী দল সঙ্গী জন বালাওয়েগা (এসজেবি) নির্বাচনে দুলাসকে সমর্থন দিয়েছিল। তামিলদের সংগঠন তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ)ও ছিল তাঁর পক্ষে। শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভের শুরুতে রাজাপক্ষে সরকারের মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন দুলাস। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ঐকমত্যের সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় টিএনএও অসন্তোষ জানিয়েছে। দলটির মুখপাত্র সুমানথিরান টুইটারে লিখেছেন, পার্লামেন্ট দেখিয়েছে, সেটা এখনো পদুজনা পার্টির খপ্পরে রয়েছে। যে দলটি ইতিমধ্যে জনগণের ম্যান্ডেট হারিয়েছে। টুইটে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতাদের কেনাবেচা হওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন সুমানথিরান। তিনিও অবিলম্বে পার্লামেন্ট বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এর মধ্য দিয়ে তিনি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবেন, নাকি রাজাপক্ষেদের মতো তাঁকেও বিদায় নিতে হবে, তা এখন দেখার অপেক্ষা।
এদিকে অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল শ্রীলঙ্কায় এখনো লোকজনকে পেট্রলস্টেশনগুলোয় লম্বা লাইন ধরতে হচ্ছে। এ রকম একটি লাইনে অপেক্ষার সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে একজন স্কুল অধ্যক্ষ প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে এভাবে ১৮ জনের মৃত্যু হলো দেশটিতে।