রিকশাচালকদের মেস: খাবারের মান কমেছে, বেড়েছে দাম
♦ মেসে প্রতিদিনের খাবারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা খরচ বেড়েছে ♦ মেস মালিকরা বলছেন, দুই বেলা খাবারে ২০ থেকে ৪০ টাকা বাড়িয়েও পোষাচ্ছে না ♦ সংসার খরচ চালাতে গিয়ে এখন ২ থেকে ৪ ঘণ্টা বেশি রিকশা টানতে হয়
রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষের সাধ্যের মধ্যে তিন বেলা খাওয়ার অন্যতম ভরসা বিভিন্ন মেস। দেশের বাজারে জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে এসব মেসে প্রতিদিনের খাবারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা খরচ বেড়েছে, কমেছে আমিষের পরিমাণ।
রায়েরবাজার আজিজ খান রোডে পাঁচ বছর ধরে একটি রিকশা গ্যারেজের পাশে খাবারের মেস চালান জুলিয়া। তাঁর মেসে এক মাস আগেও তিন বেলা খাবার পাওয়া যেত ১০০ টাকায়।
এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩০ টাকা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে খাবারের পদ বা তালিকায় কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে জুলিয়া বলেন, ‘আগে সপ্তাহে দুই দিন ব্রয়লার মুরগির মাংস এবং এক দিন পর পর ডিম আর নিরামিষ রাখা হতো। এখন তা সম্ভব হয় না। রাতে শুধু নিরামিষ। সকালে আলু ভর্তা আর ডাল দিই। এতেও পোষায় না। ’
জুলিয়ার এ মেসে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রিকশাচালক খাবার খেতে আসেন। তাঁদের বেশির ভাগ জুলিয়ার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের পাটিকাপাড়ায় থাকেন।
জুলিয়া জানান, স্বামীর সহযোগিতা না থাকলে তাঁর মেস চালানো সম্ভব হতো না। আগে ১০ জনকে খাইয়ে তাঁর প্রতিদিনের আয় ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এখন ৪০ জনকে খাইয়ে তাঁর আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
জুলিয়ার মেসের আশপাশে এমন খবারের মেস রয়েছে ১৫ থেকে ২০টি। এসব মেসের মালিকরা বলছেন, দুই বেলা খাবারে ২০ থেকে ৪০ টাকা বাড়িয়েও পোষাচ্ছে না। এতে বাধ্য হয়ে তাঁরা খাবারের দাম বাড়িয়ে মাছ, মাংস ও ডিমের পরিমাণ কমিয়েছেন।
ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠের পাশে ভ্যানে করে দুপুরে খাবার বিক্রি করেন নারগিস আক্তার। এখানে ব্রয়লার মুরগির পা, গিলা-কলিজা দিয়ে ভাত ৫০ টাকা। মাংসসহ ৭০ টাকা। মাছ দিয়ে খেলে দিতে হয় ৬০ টাকা।
নারগিস আক্তার বলেন, ‘তিন মাস আগেও ডিম-খিচুড়ি বেচতাম ২৫ টাকা প্লেট, গিলা-কলিজাসহ ভাত ৩৫ টাকা, ব্রয়লার মুরগির মাংসসহ ভাত ৪৫ টাকা। এখন সব কিছুর দাম বাড়তি। কাস্টমার খেতে চায় না। আগে ৭০ থেকে ৮০ প্লেট খিচুড়ি বিক্রি হতো। এখন ৪০ প্লেট বেচতে কষ্ট হয়ে যায়। ’
ধানমণ্ডি এলাকার রিকশাচালক শাহজাহান বলেন, ‘হোটেলে এক বেলা খাবার খেতে লাগে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এ জন্য তিন বেলা মেসেই খাই। তিন বছর আগেও খেতাম ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এরপর হইল ৫০ টাকা, পরে করল ৮০ টাকা। এক মাস আগেও ১০০ টাকায় খাবার পাইতাম। এখন দিতে হয় ১৩০ টাকা। তা-ও আগের মতো ভালো খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। ’
শাহজাহান বলেন, ‘মেসের খাবারের বাইরেও প্রতিদিন রুটি-কলায় চলে যায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তাতেও দাম বাড়তি। পাঁচ টাকার রুটি এখন ১৫ টাকা। কিন্তু রিকশা ভাড়া তো বাড়ে নাই। সংসার খরচ চালাতে গিয়ে এখন দুই থেকে চার ঘণ্টা বেশি রিকশা টানতে হয়। ’
রাজধানীর বাড্ডা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি এলাকার শাহজাহানের মতো এ রকম ২০ জন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, মেসে দু-তিন বেলা খাবার খেতে তাঁদের খরচ হয় ১১০ থেকে ১৫০ টাকা। তিন মাস আগে এই খরচ হতো ৮০ থেকে ১১০ টাকা।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, মাছ, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ায় প্রতিদিনের খাবারে এভাবে আমিষের পরিমাণ কমতে থাকলে একসময় পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। কায়িক শ্রম দেওয়া এসব মানুষের একসময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. আতিয়ার রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা কায়িক শ্রম দিয়ে থাকে, তাদের প্রচুর এনার্জি প্রয়োজন হয়। তাই প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিন ও আমিষ রাখা দরকার। যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মিনারেলস, ভিটামিন ইত্যাদি। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মাংসপেশি বৃদ্ধির জন্য যে প্রোটিন দরকার, সেটি রিকশাচালক বা শ্রমিকদের আগে থেকেই অপ্রতুল। এখন যদি এভাবে খাবার কমতে থাকে, তাহলে দেখা যাবে এদের চর্বি ও আমিষ পরিমাণমতো হচ্ছে না। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে এবং কর্মক্ষমতা কমে যাবে। ’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, রাজধানী ঢাকায় ২৭ লাখের মতো রিকশাচালক রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৪৬ শতাংশ) নিজে বা তাদের পরিবারের তৈরি করা খাবার খেয়ে থাকে। ৩৩ শতাংশ মেসে আর হোটেলে এবং রাস্তার খাবার খেয়ে থাকে ২১ শতাংশ।
সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক কোহিনূর মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের ঢাকা শহরের বেশির ভাগ রিকশার গ্যারেজ খালের পার বা অস্বাস্থ্যকর দূষিত পরিবেশে থাকে। এই রিকশাচালকরা টাকার অভাবে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারে না। বিশুদ্ধ পানি পায় না। এসব কারণে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের ৯৪ শতাংশ রিকশাচালক একাধিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে ৯০.৯০ শতাংশের জ্বর, ৬১.৬ শতাংশের সর্দি ও কাশি, ৬৯.৩ শতাংশের ব্যথা, ৪৭.৭ শতাংশের দুর্বলতা, ৩০ শতাংশের জন্ডিস, ২৫ শতাংশের ডায়রিয়া, ১৭ শতাংশের গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা এবং ৬.৩ শতাংশের হার্টের সমস্যা রয়েছে। ’