সে রাতে যেন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল
আহমেদ মুনির
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে এগিয়ে আসছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকেও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ছিল এমন মহাবিপৎসংকেত। তারপর ১৯৯১–এর ২৯ এপ্রিল শুরু সেই প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। সেই ঝড়ের রাতে যেন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী।
টেলিভিশনে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের খবর দেখতে দেখতে রাত ১১টা নাগাদ বিদ্যুৎ–সংযোগ চলে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে ঝড় শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে কিছুই হবে না, এ ধরনের ঘোষণা অনেকবারই শুনেছি—এমন ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আব্বা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে গাছপালাঘেরা বাংলো বাড়িটিতে থাকতাম আমরা।
আমি তখন উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র। সেই রাতে স্পষ্ট মানে আছে, আব্বা ডাইনিং টেবিলে বসে ঝড় নিয়ে আলাপ করছিলেন। তবে তাঁর চিন্তা কেবল আমাদের বোনকে নিয়ে। আমরা পাঁচ ভাই তখন বাড়িতে। সদ্য বিবাহিত একমাত্র বোন জাহাজের ক্যাপ্টেন স্বামীর সঙ্গে মোংলা সমুদ্রবন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজে অবস্থান করছে। তারা নিরাপদ আছে কি না, সেটাই তখন প্রধান ভাবনার বিষয় ছিল। আমরা ভাই-বোনেরা কেউই আবহাওয়ার সংবাদ বিশ্বাস করতাম না। এ নিয়ে খাওয়ার টেবিলে অনেক রসিকতা হলো। যথারীতি ১১টায় ঘুমাতেও গেলাম। রাত ১২টার দিকে আব্বা ডেকে তুললেন।
ঘুম ভেঙে শুনি গোঙানির মতো একটানা অদ্ভুত শব্দ। এমন শব্দ কখনো শুনিনি আগে। কিসের শব্দ বুঝতে সময় লাগছিল। আব্বা তাগাদা দিয়ে বললেন, শোয়ার ঘর থেকে বড় হল ঘরের মতো ড্রয়িংরুমে এসে বসতে। কেন, সেটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। পিঠাপিঠি বড় ভাই মেহেদী আমাকে টেনে নিয়ে গেল বারান্দার দিকের জানালাটার কাছে। টানা বারান্দায় টি–টেবিল আর চেয়ার উল্টে পড়েছে। বারান্দার সামনে টেনিস কোর্ট, এরপর মেহগনি আর আমগাছের সারি। সেসব গাছের ওপরের আকাশটা ঘন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এত রাতে এমন লাল আকাশ দেখে চমকে গেলাম। চাপা গোঁ গোঁ শব্দটা তখন ধীরে ধীরে বাড়ছিল। লাল আকাশের দিক থেকে এক ঝলক বাতাস কিছুক্ষণ পরপর এমন গতিতে আছড়ে পড়ছিল যেন বাতাস নয়, কামানের গোলা। টেনিস কোর্ট লাগোয়া আঙিনা ঘেঁষে গ্যারেজ। সেখানে বাবুর্চি হারিস মিঞা থাকেন।
১০ মিনিটের মধ্যে বাতাস এমন তীব্র হলো যে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা। এর মধ্যেই গ্যারেজের টিনের চাল মুহূর্তে উড়ে যেতে দেখলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে হারিস ভাই এসে দাঁড়ালেন বাঁধানো চত্বরটাতে। আমরা তখন প্রাণপণে ডাকছি তাকে ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাতাসে উড়ে যাওয়া ঠেকাতে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটি কানের কাছে এনে তিনি আজান দেওয়া শুরু করলেন। গোটা পৃথিবীটাই যেন উল্টে যাচ্ছিল, তখন অবিচল দাঁড়িয়ে তিনি আজান দিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘আল্লাহ হু আকবর’। আমি কিছুতেই আর কান্না সামাল দিতে পারলাম না। হারিস ভাইকে বুঝি আর রক্ষা করা গেল না। ততক্ষণে আমাদের ঘরের বাইরের তিনটি আউট হাউসের চাল উড়ে গেছে। বাড়ির সামনে–পেছনের বেশ কয়েকটা গাছ ভেঙে পড়ারও শব্দ পেলাম। বাংলো বাড়ির ওপরের চালা টিনের আর নিচের সিলিং কাঠের হয়। বাতাসে সেই চালার একটা অংশ উড়িয়ে নিয়ে গেল ঝড়ের প্রথম ৪৫ মিনিটের মধ্যে। বড় ভাই পারভেজ ততক্ষণে বাইরে গিয়ে হারিস ভাইসহ আউট হাউসের বাসিন্দা কয়েকজনকে ঘরে নিয়ে এলেন।
গির্জার বড় দরজার মতো আমাদের সদর দরজাটাও খুব ভারী আর শক্ত। সেই দরজাটা এই বাতাসে বাদামের খোলের মতো মনে হচ্ছিল। যথাস্থান থেকে বিচ্যুত হতে হতেও যেন সেটি উড়ে যাচ্ছিল না। বাড়ির দেয়ালে ছাদে মুহুর্মুহু ভারী জিনিস পড়ার শব্দ। বুঝতে পারলাম, টিন, গাছের গুঁড়ি, ডাল—সবই এসে পড়ছে। এক একটা বড় শব্দ হয় আর ড্রয়িংরুমে আশ্রয় নেওয়া আমাদের মধ্যে ভয়ের স্রোত খেলে যায়। আম্মা টানা দোয়া–দরুদ পড়ে যাচ্ছিলেন। রাত তিনটার দিকে প্রতিবেশী বাড়ি থেকে ফোন এল। তখন টেলিফোন লাইন ঝড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও কেবল রেলওয়ের ডিজিটাল ফোনলাইন ঠিক ছিল। সেটা মাটির নিচ দিয়ে যাওয়ায় ঝড়ের কোনো আঁচ পড়েনি।
প্রতিবেশী রেলওয়ের এক প্রকৌশলীর বাড়ির দেয়াল ভেঙে পড়েছে। মাথা ফেটেছে তাঁর স্ত্রীর। ভদ্রলোক রক্তাক্ত স্ত্রী নিয়ে বসে রয়েছেন। আব্বা এমন ঝড়েও দ্রুত মেডিকেল ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। তারপর তীব্র ঝড়ের মধ্যেই ছুটলেন প্রতিবেশীকে চিকিৎসা দিতে। সেই মুহূর্তে আম্মার মুখ খুব মনে পড়ে। আম্মা নিষেধ করতে পারছিলেন না। কিন্তু চোখের পানিও বন্ধ করতে পারছিলেন না।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আব্বা ফিরলেন, অক্ষত। ভোর পাঁচটার দিকে ঝড়ের বেগও কমে এল। আমরা ধীরে ধীরে বের হলাম সবাই। গাছে ঘেরা বাড়িটিতে ৩০টির মতো বড় গাছের একটিও দাঁড়িয়ে নেই। সবই পড়ে গেছে। বিদ্যুতের খুঁটি, পানির ট্যাংক, সীমানাদেয়াল—সবই। বাড়ির সদর গেটের ঢালু রাস্তাজুড়ে টিন আর গাছের স্তূপ। এত সকালেও কিছু মানুষ এসেছে টিন কুড়াতে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে নামতে নামতে দেখি একটা গরু কাত হয়ে পড়ে আছে। ঘাড়টা ওলটানো। লালখান বাজারের সদর রাস্তাজুড়েও একই দৃশ্য। গাছ, টিন আর ইটের স্তূপ। যত দূর চোখ যায় এমন ধ্বংসচিহ্ন ছড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে