কোনো উত্তাপ নেই, মিছিল নেই, নেই বুক চাপড়ানো কোনো কান্না!
৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুর মিছিলে শরিক হলেন আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা ওয়াসিম। অভিনেত্রী কবরীর মৃত্যুর একদিন পর একই সময়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের অ্যাকশন এবং ফোক ফ্যান্টাসির নায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে শীর্ষ নায়কদের একজন ছিলেন তিনি। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রাজমহল, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, দি রেইন, বেদ্বীন, রাজ দুলারী, মোকাবেলা, আসামী হাজির, লাল মেম সাহেব ছিল অন্যতম।
ওয়াসিমের পুরো নাম মেজবাহউদ্দীন আহমেদ। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ওয়াসিম ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি বডি বিল্ডার হিসেবে নাম করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি বডি বিল্ডিং এর জন্য ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করেন।
প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এস এম শফীর হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক ঘটে ওয়াসিমের। ১৯৭২ সালে শফী পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হন তিনি। এতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। ১৯৭৪ সালে আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম।
দেড়শ’রও বেশী ছবিতে নায়ক ছিলেন ওয়াসিম। তার অভিনীত প্রায় প্রতিটি ছবিই ছিল সুপারহিট । ‘দি রেইন’ তাকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। পৃথিবীর ৪৬টি দেশে মুক্তি পায় ‘দি রেইন’। বেদ্বীন ছবিও ছিল তার ক্যারিয়ারের আরেক টার্নিং পয়েন্ট। দুটি ছবিতেই ওয়াসিমের নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া।
পরবর্তী সময়ে ওয়াসিম-অলিভিয়া জুটি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়া ‘বাহাদুর’,লুটেরা, ‘রাজ দুলারী’, লাল মেম সাহেব, ঈমান, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, কে আসল কে নকল, দোস্ত দুশমন, মানসী, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, রাতের পর দিন, মিস লোলিতা, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, জীবন সাথী, রাজনন্দিনী, বিনি সুতার মালা, বানজারান চলচ্চিত্রের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়।
তার সে রেকর্ড ভাঙতে পারেনি কেউই। শাবানা, সুচরিতা, জেবা, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, সুজাতা প্রমুখের বিপরীতে তার সাবলীল অভিনয় দারুণভাবে লুফে নেয় দেশের তাবৎ দর্শক। তার মুক্তিপ্রাপ্ত একেকটি ছবি সিনেমা হলগুলোতে চলত মাসের পর পর মাস। সে ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলগুলোতে উপচে পড়া ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। একটি টিকিটের জন্য দুই গ্রুপে চলত মারামারি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াসহ আরো কত কাহিনী। সেই কিংবদন্তী নায়ক যেন নীরবেই চলে গেলেন। কোনো উত্তাপ নেই, মিছিল নেই, নেই বুক চাপড়ানো কোনো কান্না! এ এক বিচিত্র সময়!
বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোজীর ছোট বোনকে বিয়ে করেছিলেন ওয়াসিম। দুটি সন্তান হয় – পুত্র দেওয়ান ফারদিন এবং কন্যা বুশরা আহমেদ। ২০০০ সালে তার স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন ওয়াসিম। ২০০৬ সালে ওয়াসিমের কন্যা বুশরা আহমেদ চৌদ্দ বছর বয়সে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পরীক্ষা চলাকালীন নকলের অভিযোগ তার পরিবারকে জানাবার কথা শুনে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে বুশরা লাফ দেন।
অন্যদিকে পুত্র ফারদিন লন্ডনের কারডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্যারিস্টার হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন।❐
লেখক: চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও সেক্রেটারি, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টারস্ এসোসিয়েশন