Our Concern
Ruposhi Bangla
Hindusthan Surkhiyan
Radio Bangla FM
Third Eye Production
Anuswar Publication
Ruposhi Bangla Entertainment Limited
Shah Foundation
Street Children Foundation
March 13, 2025
হেডলাইন
Homeআন্তর্জাতিকমাদকাসক্তির কারণে জন্ম হচ্ছে অস্বাভাবিক শিশুর

মাদকাসক্তির কারণে জন্ম হচ্ছে অস্বাভাবিক শিশুর

মাদকাসক্তির কারণে জন্ম হচ্ছে অস্বাভাবিক শিশুর

একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন পুরো পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। খুশির আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একজন মাদকাসক্তের পরিবারে যখন কোনো সন্তান আসে তখন খুশি রূপ নেয় বিষাদে। দু’চোখে দেখা দেয় জমাট বাধা অশ্রু।

একজন মাদকসেবীর মাদক নেওয়ার কারণে তার শরীরের কোষগুলোর পরিবর্তন ঘটে যায়। হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সর্বোপরি মাদকের নীল বিষ ছড়িয়ে পড়ে তার সন্তানের ওপরেও। ফলে মাদকসেবীদের সন্তান অ্যাবনরমাল বা অস্বাভাবিক হয়ে জন্ম নিচ্ছে। একুশে টিভি অনলাইনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন সব তথ্য।

রুখসানা বেগম (ছদ্দ নাম) থাকেন রাজধানীর বেগুনবাড়িতে। পারিবারিকভাবেই তার বিয়ে হয়। স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো। বিয়ের কিছুদিন পর তিনি জানতে পারেন তার স্বামী মাদকাসক্ত। সে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে। তার দাবি, স্বামীকে মাদক থেকে ফেরাতে অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু ফেরানো সম্ভব হয়নি। দেড় বছরের মাথায় বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়। তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন। এরপর সে প্রতিশ্রুতি দেয় মাদক ছেড়ে দেবে। কয়েক দিন ঠিক থেকে আবার শুরু করে। এ নিয়ে পরিবারে সুখ বলতে আর কিছুই থাকে না। এর মধ্যে সংসারে একটি পুত্র সন্তান আসে। রুখসানার মতে, তার কপাল এত খারাপ যে সন্তানটি কিছুটা অস্বাভাবিক বা অ্যাবনরমাল হয়ে জন্ম নেয়।

রুখসানা বলেন, ‘‘সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ভেবে ছিলাম অন্তত একটা অবলম্বন পেলাম। কিন্তু আমার দুঃখ আরও বেড়ে গেল। সন্তানটি স্বাভাবিক নয়। ডাক্তার বলেন মাদকের প্রভাব সন্তানের ওপর প্রভাবিত হয়ে এমনটি হতে পারে।’’

বিয়ের আগে রোখসানা জানতেন না তার স্বামী মাদকাসক্ত। যখনই জানতে পারেন তার স্বপ্নময় জীবনটি একেবারে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তার গায়েও হাত তুলে মাদকাসক্ত স্বামী। অন্ধকার রাতে তার অব্যক্ত কষ্টের হাহাকার কেউ দেখতে পায় না। এভাবে অসংখ্যা মাদকাসক্তের পরিবারে জন্ম নিচ্ছে অ্যাবনরমাল বা অস্বাভাবিক শিশু।

পারভিন সুলতানা (ছদ্দ নাম) থাকেন বাড্ডা। বিয়ের পরই তিনি জানতে পারেন স্বামী মাদকাসক্ত। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। স্বামীকে মাদক মুক্ত করতে বিভিন্ন মাদকাসক্ত কেন্দ্রে চিকিৎসাও করিয়েছেন। কিন্তু এরপরও সে মাদক ছাড়তে পারেনি। এর মাঝে তাদের কোল জুড়ে একটি ছেলে সন্তান আসে। কিন্তু ছেলেটি কিছুটা অস্বাভাবিক।

পারভিনের ভাষায়, ‘‘আমি জানিনা কেন এমন হলো। আমার বাচ্চাটা কিছুটা অ্যাবনরমাল মনে হচ্ছে। তার চিকিৎসা করাচ্ছি। ডক্তার বলছেন সমস্যা সেরে যাবে।’’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাঁজা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, ফেনসিডিল ও ইয়াবার মতো মাদকে যারা আসক্ত হচ্ছে তাদের শরীরে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটে। যা তার সন্তানের ওপর প্রভাবিত হয়। মাদকে শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। প্রজননক্ষমতার বিকাশকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। মাদকের প্রভাবে সন্তান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি বা অস্বাভাবিক হয়ে জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি।

স্বামী বা স্ত্রী মাদকাসক্ত হলে সন্তান কেন অ্যাবনরমাল হবে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. তাজুল ইসলাম একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘‘গর্ভাবস্থায় কোনো মা যদি মাদক সেবন করে তখন সেটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে। এর প্রভাব সরাসরি সন্তানের ওপর পড়ে। আর বাবা যদি মাদকসেবী হয় এ ক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ বা অ্যাবনরমাল শিশু জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মাদক সেবনের কারণে মা বা বাবার শরীরের কোষগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। এটা সন্তানের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া পরিবারে ঝগড়া, মারামারি, অশান্তি এসব সন্তানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে সন্তানও অনেক ক্ষেত্রে এ কারণে মাদকাসক্ত হয়ে যায়।’’

বর্তমানে সারাদেশে ছেয়ে গেছে মাদক। মাদকের এই ভয়াল গ্রাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে যুব সমাজ। যারা আজকে মাদকে আসক্ত তারাই জন্ম দিবে আগামী প্রজন্ম। সেই প্রজন্ম যদি সুস্থভাবে গড়ে না ওঠে তাহলে পুরো জাতিই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে।

বিভিন্ন রিহ্যাবিলিটি সেন্টার ও মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে জানা যায়, মাদকসেবীদের সন্তান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি বা অস্বাভাবিক হয়ে জন্ম নিচ্ছে। তাদের কাছে এ রকম অনেক রোগী আসেন যাদের সন্তান অ্যাবনরমাল। তারা জানান, আমাদের কাছে অনেক মাদকসেবী আসেন যাদের সন্তান অস্বাভাবিক। এ ধরনের ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। অস্বাভাবিক সন্তান জন্মের হার বাড়ছে। আগে আমরা এসব বিষয়ে জানতে না পারলেও এখন অনেকে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করছেন।

এ রকম একটি মাদক সেবাকেন্দ্র হলি লাইফ। এর ব্যবস্থাপক রিয়াজ উদ্দিন একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, আমাদের এখানে অসংখ্যা রোগী রয়েছে। আমরা তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি। তবে এদের মধ্যে যারা বিবাহিত তাদের কারো কারো সন্তান অস্বাভাবিক এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। প্রায়ই এ ধরনের রোগী আমাদের কাছে আসছে। বাবার মাদক সেবনের কারণে এর প্রভাব সন্তানের ওপর পড়েছে বলে আমি মনে করি।

একই ধরনের কথা বলেন ‘অর্জন’ মাদকাশক্তি চিকিৎসা ও পূণর্বাসন কেন্দ্রের কেইস ম্যানেজার রিয়াদ রহমান। তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে যারা মাদকাসক্ত তাদের সন্তান প্রতিবন্ধি বা অস্বাভাবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে এটা সঠিক। আমাদের কাছে এ ধরনের অনেক রোগী আছে। তারা চিকিৎসা নিচ্ছে। অনেকে গোপনে এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক সময় মানুষ এসব বিষয়ে পরার্মশ করতে লজ্জা পেত। এখন অনেকে সচেতন তারা যে কোনো সমস্যা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করছেন। সন্তানের অস্বাভাবিকতা নিয়েও কিভাবে সুস্থ করা যায় এ নিয়ে পরামর্শ করছেন।’’

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘প্রশান্তি’র এডমিন ফারুক রহমান মিন্টু বলেন, আমার এখানে ৪/৫ জন রোগী আছেন যাদের সন্তান অ্যাবনরমাল। এ ধরনের সমস্যা এখন দিনকে দিন বাড়ছে। মাদক তৈরির কেমিক্যাল পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে এটা বেশি ক্ষতি করছে। এক সময় মাদক শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতো আর এখন এটা ব্রেনের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করছে।’’

মাদক নেওয়ার ফলে এর প্রভাব সন্তানের ‍ওপর পড়ছে। সন্তান অস্বাভাবিক হচ্ছে বাংলাদেশে এর কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘‘বর্তমানে বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে আমরা দেখি মাদকাসক্তদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মা-বাবা যদি মাদক সেবন করে, তাদের কারণে সন্তানের মধ্যে জার্ম বা ক্ষতিকর একটা প্রভাব প্রবেশ করে। যার কারণে সন্তানের মধ্যে কিছুটা অ্যাবনরমালিটি বা অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়। এবং এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মাদক নেওয়ার কারনে অস্বাভাবিক সন্তান হতে পারে। তবে আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। উন্নত দেশগুলোতে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়।’’

বিষয়টির আরও গভীর অনুসন্ধানের জন্য যাওয়া হয় তেজগাঁও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। সেখানকার নিরাময় কেন্দ্রের রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, ডাক্তার মো. রাহেনুল ইসলাম ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘‘মা যদি মাদকে আসক্ত হয় তাহলে এটা সরাসরি প্রভাব ফেলে। এর কারণে সন্তান খর্বকায় হয়ে যায়, সন্তানের খিচুঁনি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি হতে পারে, সন্তানের মধ্যে অস্থিরতা বেশি থাকে, অস্বাভাবিক সন্তান হয়। এছাড়া পরিণত বয়সে মা যদি অ্যালকোহল নেয় তাহলে সন্তান ৪০-৬০ ভাগ থাকে যারা মাদকাসক্ত হবে। আর বাবার মাদক নেওয়ার কারনেও একই ধরনের প্রভাব তৈরি হয়। পিতা মাতা মাদক নিলে পরিণত বয়সে সন্তানের মাদক নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মা বা বাবার মাদক নেওয়ার ফলে স্পার্ম এর পরিবর্তন ঘটে। যা পরবর্তীতে সন্তানকে আক্রান্ত করে।’’

‘‘আর একটা বিষয় মা-বাবা যদি সব সময় একে অপরকে গালাগাল করে, সেটা সন্তানের ওপর পড়ে। এই আচরণগুলো পরবর্তীতে জেনেটিক্যালি তার মধ্যে প্রভাবিত হয়।’’ বললেন ডাক্তার মো. রাহেনুল ইসলাম।

বর্তমানে আমাদের সমাজে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মুখগুলো মাদকের বিষে নীল। এ অবস্থা চলতে থাকলে জাতি একদিন মেধা শুন্য হয়ে যাবে। তাদের মাধ্যমে যে সন্তানগুলো জন্ম হবে তারা কোনো না কোনো ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসবে। যারা সমাজের কান্ডারি হওয়ার কথা তারা হয়ে ওঠবে বোঝা হিসেবে।

এ বিষয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নাসরিন ওয়াদুদ। তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদক ঢুকে গেছে। এর জন্য কে দায়ী? দায়ী হলো এই সমাজের কিছু প্রভাবশালী মানুষ। যারা মাদক ব্যবসা করে নিজেরা কোটি কোটি টাকা বানিয়েছে। তারা সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আইন তাদের কিছুই করতে পারে না। আমি মনে করি এদের এখন থামানো উচিৎ। যত বড় ক্ষমতাধরই হোক জাতিকে, যুব সমাজকে রক্ষা করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সীমান্ত দিয়ে যাতে মাদক আসতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

Share With:
Rate This Article
No Comments

Leave A Comment