জনপ্রতিনিধিদের দেখা নেই, অভিযোগ বানভাসিদের
সুনামগঞ্জের বন্যা উপদ্রুত এলাকায় তীব্র খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েক দিন ধরে পানিতে আটকা থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের দেখা মিলছে না বলে অভিযোগ বানভাসিদের।
সোমবার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অনেকে পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত ত্রাণ। এর ফলে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে এসব এলাকার বানভাসি মানুষের।
আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু খাবার মিললেও যারা বাড়িতে অবস্থান করছেন সেখানে এখনো কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি বলে জানান বন্যার্তরা।
ছাতক দোয়ারার এমপি মুহিবুর রহমান মানিক বলেন,পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ রয়েছে কিন্তু নৌকার অভাবে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না।
সরেজমিনে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ছোট বিহাই গ্রামের কবির আহমেদের বাড়িতে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুরে দেখা যায়, ৩২০ থেকে ৩৫০ মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করছেন সেখানে। একেকটি রুমে নারী, শিশু, বৃদ্ধ হাঁসফাঁস করছেন, ক্ষুধায় কাঁদছে শিশুরা। বাড়ির ছাদে গবাদিপশুদের রাখা হয়েছে।
সেখানে কথা হয় বৃদ্ধা রমিজা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৭০ বছর ধরে কখনো তার বসতভিটায় পানি ওঠেনি। মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে আত্মীয়-স্বজনরা কে কোথায় কেমন আছেন জানেন না।
অন্যদিকে দোলার বাজার ইউনিয়নের, মঈনপুর জনতা মহাবিদ্যালয় ও মঈনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের তৈরি আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ৫০০-৬০০ মানুষ।
মঈনপুর গ্রামের আসকির আলী বলেন, আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে আছি পাঁচ দিন। কেউ আমাদের কোনো খোঁজ নিচ্ছে না। স্থানীয় প্রবাসী ও বিত্তশালীদের উদ্যোগে অল্প কিছু খাবারই তাদের ভরসা। এখানে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষরা।
একই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আলতাব আলী বলেন, ভোট আসলে চেয়ারম্যান আসেন, প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বানের জলে ভেসে গেলেও খবর নেয়ার জন্য কোনো জনপ্রতিনিধি এখানে আসেননি। আমরা বেঁচে আছি, না মরে গেছি সেই খবর নেয়ার ও কেউ নেই।
ফোনে উপজেলার সর্বশেষ ইউনিয়ন ভাতগাঁও থেকে কলেজছাত্র মিলাদ আহমেদ শুভ জানান, দয়া করে আমাদের জন্য কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা করেন। এখানে বহু পরিবার না খেয়ে আছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপজেলার সিংচাপড় গ্রামের পাভেল আহমেদ পোস্ট করে জানান, আমাদের সিংচাপড় গ্রামের অনেক বাড়িঘর বানের পানিতে ভেসে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ তো দূরের কথা সমবেদনা জানাতেও কেউ আসেনি।
তবে ব্যতিক্রম ও দেখা গেছে। উপজেলার ধারণ বাজার এলাকায় দেখা যায়, উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান লুঙ্গি পড়ে ভ্যানে করে, বিস্কুট, চিড়া, মুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার নিয়ে রওনা হয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশ্য। অন্যদিকে ছোট এক নৌকায় করে ত্রাণ নিয়ে রওনা দিয়েছেন উত্তর খুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্লাল আহমেদ।
এ সময় তিনি জানান, সাধ্যমতো মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। আরও ত্রাণ ও পরিবহনের জন্য নৌকা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বন্যা কবলিত সুনামগঞ্জে নৌকার জন্য হাহাকার চলছে। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও মিলছে না নৌকা। এই সুযোগে অনেক নৌকার মাঝি এক হাজার টাকার নৌকা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া হাঁকাচ্ছে। এ কারণে পানিবন্দী লোকজনের উদ্ধার তৎপরতা ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নেয়া ত্রাণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ছাতক উপজেলা শিক্ষা অফিসার পুলিন চন্দ্র রায় জানান, বন্যার কারণে বৃহস্পতিবার তিনিসহ তার আরো দুই সহকর্মী অফিসে আটকা পড়েন। শুক্রবার ৫ হাজার টাকায় একটি বলগেট নৌকা ভাড়া করে তারা তিনজন কোম্পানীগঞ্জ হয়ে সিলেটের টুকেরবাজারে এসে পৌঁছান। এরপর তিনি নগরীর টিলাগড়ের বাসায় পৌঁছান।
তিনি জানান, নৌকা মালিকরা ডিজেলের অজুহাতে নৌকা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে উপজেলার জাউয়া বাজার ঘুরে দেখা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই বাজারে। ফলে কয়েকগুণ বেশি দামে বাধ্য হয়ে ত্রাণের জন্য পণ্য কিনতে হচ্ছে। বন্যার আগে যে আলু বিক্রি হচ্ছিল ২৫ টাকা এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়, এক প্যাকেট মোমবাতি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-২০০ টাকায়। বাজারে নেই চিড়া-মুড়ি, কেরোসিন, ডিজেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, বন্যায় এবার অধিকাংশ দোকান ডুবে যায়। ফলে পেঁয়াজ-আলুসহ অনেক পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়া হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় বাজারে দেখা দিয়েছে পণ্য সংকট।
সার্বিক বিষয়ে এমপি মুহিবুর রহমান মানিক জানান, তাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণের মজুত আছে। কিন্তু পরিবহনের অভাবে ত্রাণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। ত্রাণের ট্রাক তারা পাঠাতে পারছেন না শুধুমাত্র যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে।
তিনি জানান, সরকারের কাছে যে পরিমাণ ত্রাণ চাওয়া হচ্ছে, সেই পরিমাণ ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।