মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডের মানুষের রাষ্ট্রের সমস্যার সমাধান হলেও শ্রেণি সমস্যার সমাধান হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘নতুন দিগন্ত’আয়োজিত তার আত্মজৈবনিক বক্তৃতায় এ কথা বলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার গান-কথামালা আর ফুলেল শুভেচ্ছায় উদযাপিত হয় বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ, লেখক-গবেষক ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৭তম জন্মদিন।
বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রের চাইতে সমাজ বেশি শক্তিশালী, কিন্তু কর্তৃত্ব করছে রাষ্ট্র। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। শ্রেণী বৈষম্যের সমাধান না হলে মানুষের জীবনে শান্তি আসবে না। এক রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বদল ঘটেনি।
তিনি ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্বসহ দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে মানুষের জীবনের পরিবর্তন ও তার প্রভাবকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞাতার আলোকে তুলে ধরেন।
স্মৃতি বক্তৃতায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমার বাবা ছিলেন আমলাতান্ত্রিক, মা ছিলেন গণতান্ত্রিক। বাবা ছিলেন আশাবাদী, মা তার বিপরীত। অর্থাৎ জীবনের সব ক্ষেত্রে খুব বাস্তববাদী। ফলে আমি যতটা না বাবার সন্তান তার চেয়ে অধিক মায়ের সন্তান আমি। মায়ের অনেক গুণ পেয়েছি, আর তা বুঝলাম ধীরে ধীরে চলতে চলতে।
এইভাবে শৈশব, কিশোরের নানান গল্প। শিক্ষা জীবনে মা বাবার ভূমিকা, দেশ-বিদেশে উচ্চশিক্ষার অভিজ্ঞতা বয়ান, শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়াবহ সময় মোকাবেলা, একাত্তরে তিনি মারা গেছেন এমন সংবাদ ছাপা হয়েছে বিদেশে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউজ লেটারে— এমন অসামান্য কিছু স্মৃতি উপস্থিত অগণিত দর্শকের মধ্যে সাবলীলভাবে বলে যান প্রায় দেড় ঘন্টায়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করেন অধ্যাপক আজফার হোসেন। পরে সঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা। তারা গেয়ে শোনায় ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটি। এ ছাড়া সঙ্গীত পরিবেশন করে বিবর্তন ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা।
জন্মদিন উপলক্ষে ডেইলি স্টার বুকস প্রকাশ করেছে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নির্বাচিত সাক্ষাৎকার সংকলন ‘আজ ও আগামীকাল’। সম্পাদনা করেছেন ইমরান মাহফুজ। বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত ২১টি সাক্ষাৎকার রয়েছে এই সংকলনে। প্রচ্ছদ করেছেন মনন মোরশেদ। দাম ৪০০ টাকা। অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
বইতে উঠে এসেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শনে অবিচল চিন্তা, সমাজ বিপ্লবে তরুণদের ভূমিকা। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে গভীর দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনা। সামাজিক সংকট ও সামাজিক মুক্তিতে সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা।
তাকে শুভেচ্ছা জানান কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জোনায়েদ সাকী, কবি মোহন রায়হান, আসাদ মান্নানসহ অনেকে। বিভিন্ন সংগঠনও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।
এ ছাড়া শুভেচ্ছা জানায় উদীচী, স্টুডেন্ট ওয়েজ, গণমুক্তি আন্দোলন, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সিপিবি, বাসদ, সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র, বহ্নিশিখা, ছাত্র ফেডারেশন, স্বদেশ চিন্তা সংঘ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদ, প্রগতি লেখক সংঘ, অবসর প্রকাশন, সমকাল, চ্যানেল আই, নব আনন্দ শিশু থিয়েটার, কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পরিষদ।
উল্লেখ্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন বিক্রমপুরের বাড়ৈখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মসূত্রে তার শিক্ষাজীবনের প্রথমভাগ কেটেছে রাজশাহীতে। পরে ঢাকা, কলকাতা ও যুক্তরাজ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি।