Our Concern
Ruposhi Bangla
Hindusthan Surkhiyan
Radio Bangla FM
Third Eye Production
Anuswar Publication
Ruposhi Bangla Entertainment Limited
Shah Foundation
Street Children Foundation
December 22, 2024
হেডলাইন
Homeপ্রধান সংবাদবঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদে জেনারেল জিয়ার মন্তব্য

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদে জেনারেল জিয়ার মন্তব্য

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদে জেনারেল জিয়ার মন্তব্য

অন্যান্য দিনের মতোই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ই অগাস্ট রাত ৮টা নাগাদ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন।

খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১২টার মধ্যেই সে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে যায়।

তখন সে বাড়ির নীচ তলায় একটি কক্ষে কর্মরত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলাম। রাত তিনটা নাগাদ ঘুমাতে যান তিনি।

এর কিছুক্ষণ পরেই সে বাড়িতে টেলিফোনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি মুহিতুল ইসলামকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কারণ রাষ্ট্রপতি তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।

মুহিতুল ইসলাম ২০১৬ সালে মারা যান। ১৯৯৬ সালে তিনি শেখ মুজিব হত্যা মামলার বাদী হয়েছিলেন।

এ এফ এম মুহিতুল ইসলাম ২০১০ সালে বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় আক্রমণ করছে। ওই অবস্থায় আমি পুলিশকে টেলিফোনের চেষ্টা করছিলাম। তারপরে বঙ্গবন্ধু উপর থেকে নিচে নেমে এলেন। গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরা। তখন উনি আমাকে বললেন যে আমার কাছে দে।’

‘আমার কাছ থেকে তিনি রিসিভারটা নিলেন। নিয়ে বললেন যে , হ্যালো আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি। উনি একথা বলার সাথে সাথেই বৃষ্টির মতো গুলি আসা শুরু হলো। উনি গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বললেন যে পুলিশ সেন্ট্রি,আর্মি সেন্ট্রি – এত গুলি চলছে তোমরা কী করো? আমিও ওনার পিছু এসে দাঁড়ালাম। উনি একথা বলেই উপরে উঠে চলে গেলেন।’

এ গোলাগুলির সময় রাষ্ট্রপতিসহ তাঁর বাড়ির কেউ ঘটনা সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন নি।

শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালকে যখন বাড়ির নিচ তলায় গুলি করে হত্যা করা হয় তখন ঘটনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, বলছিলেন মুহিতুল ইসলাম।

ধানমন্ডির সে বাড়িতে সশস্ত্র হত্যাকারীরা প্রথমে হত্যা করে শেখ কামালকে। গোলাগুলির আওয়াজ শোনার পর ঘটনা সম্পর্কে জানতে বাড়ির নিচ তলায় নেমে আসেন শেখ কামাল।

‘পাঁচ-ছয়জন আর্মি, কেউ কালো পোশাকধারী কেউ খাকি পোশাকধারী – ওনার সামনে এসে বললো হ্যান্ডস আপ। কামাল ভাই বলছে, আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। তখনই সাথে-সাথে ব্রাশ ফায়ার।’

গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শেখ কামাল।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যখন আক্রমণ হয় তখন কোনও ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই হত্যাকারীরা পুরো বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।

মুহিতুল ইসলাম বলছিলেন, একজন রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যে ধরণের নিরাপত্তা থাকা দরকার সেটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিল না। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির বাড়িতে আক্রমণের পরেও কোনও তরফ থেকে কোনও ধরনের সহায়তা আসে নি।

শেখ কামালকে হত্যার পর হত্যাকারীরা বেপরোয়া গুলি চালিয়ে বাড়ির ওপরের দিকে যাচ্ছিল। ওপরে ওঠেই শুরু হয় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। চারিদিকে তখন শুধু গুলির শব্দ।

‘উপরে তো তাণ্ডবলীলা চলছে। চারিদিকে একটা বীভৎস অবস্থা। ঠিক সে মুহূর্তে উপর থেকে চিৎকার শুরু করল যে পাইছি পাইছি। এরপরে বঙ্গবন্ধুর একটা কণ্ঠ শুনলাম। তিনি বললেন, তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস? এরপরে ব্রাশ ফায়ার। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ আমরা আর শুনতে পাই নি।’ সে রাতের ঘটনা এভাবে বর্ণনা করলেন মুহিতুল ইসলাম ।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধু।

এ এফ এম মুহিতুল ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী ধানমন্ডির সে বাড়িটিতে সর্বশেষ হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে। তখন তার বয়স মাত্র দশ বছর। এ হত্যাকাণ্ডটি হয়েছিল মুহিতুল ইসলামের সামনে।

‘রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বলল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারল। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল যে ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব।’ এক ঘাতক এসে ওকে বলল, ‘চল্‌ তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।’ বিশ্বাস করতে পারি নি যে ঘাতকরা এত নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।’

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার পর ঘাতকরা একে অপরকে বলছিল, ‘অল আর ফিনিশড (সবাই শেষ)।’

সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা। সে সময় ঢাকা সেনানিবাসে লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। আমিন আহমেদ চৌধুরী ২০১৩ সালে মারা যান।

২০১০ সালে বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আমিন আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে।

আমিন আহমেদ চৌধুরী তখনো জানতেন না যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সৈন্যরা আমিন আহমেদ চৌধুরী এবং তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে। জেনারেল জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান।

জেনালের জিয়াউর রহমানের বাড়িতে ঢোকার সময় রেডিওর মাধ্যমে আমিন আহমেদ চৌধুরী জানতে পারেন যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।

‘জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করে নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে আসলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাফায়াত কী হয়েছে?’ শাফায়াত বললেন, ‘অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড্ আ ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনও আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।’ তখন জেনারেল জিয়া বললেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’

সেনানিবাসের দুটি ব্যাটালিয়ন এ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত থাকলেও পুরো সেনাবাহিনী সেটার পক্ষে ছিল না বলে উল্লেখ করেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনার খবর কেন আগে জানা সম্ভব হয় নি এবং কেন সেনাবাহিনীর অন্য কোনও ইউনিট এগিয়ে আসে নি সেটি আজও এক বিরাট প্রশ্ন।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আক্রমণের সময় শেখ মুজিবুর রহমান তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোন করে তার বাড়িতে আক্রমণের কথা জানিয়েছিলেন।

কর্নেল জামিল তখন সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে।

কিন্তু সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছলে তার গাড়ি রোধ করে অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সৈন্যরা।

খন্দকার মোশতাক আহমেদের পুরনো ছবি।

সে বাধা উপেক্ষা করে কর্নেল জামিল সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

সকাল ১০টার দিকে আমিন আহমেদ চৌধুরী গিয়েছিলেন সে বাড়িতে। ভোর সাড়ে চারটা নাগাদ হত্যাকাণ্ড হলেও তখন সেখানে মৃতদেহ দেখেছেন তিনি।

আমিন আহমেদ চৌধুরী সামরিক পোশাক পরে সেখানে গেলেও তাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না সৈন্যরা।

আমিন আহমেদ চৌধুরী বলছিলেন, ‘আর্টিলারি রেজিমেন্টের কিছু ট্রুপস ছিল সেখানে। মেজর হুদা ছিলেন। আমি যেহেতু হুদাকে চিনতাম, তাকে বলার পর সে আমাকে ঢুকতে দেয়। আমি দোতলার সিঁড়িতে উঠতেই বঙ্গবন্ধুর লাশটা দেখি। তার চশমা ও পাইপটাও পড়ে ছিল। দূর থেকে ভেতরে দেখলাম বেগম মুজিব পড়ে আছেন। যে লোকটার অঙ্গুলি হেলনে পঁচাত্তর মিলিয়ন লোক উঠছে বসছে, সে লোকটাকে তার সৃষ্ট আর্মি মেরে ফেলল। এটা কী করে সম্ভব? পাকিস্তানিদের কাছে মারা যায় নাই, মারা গেল শেষ পর্যন্ত বাঙালির কাছে।’

সে অভ্যুত্থানের পর অনেকে তাকিয়ে ছিলেন তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর প্রতিক্রিয়ার দিকে।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর কোনও সংঘাত তৈরি হয় কী না সেটি নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরণের কিছু ঘটে নি।

রক্ষীবাহিনীর দিকে থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর উল্টো রক্ষীবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বলে জানান আমিন আহমেদ চৌধুরী।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে আমিন আহমেদ চৌধুরী দুপুর নাগাদ পৌঁছেন সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তরে।

আমিন আহমেদ চৌধুরীর দায়িত্ব ছিল রক্ষীবাহিনী যাতে আতঙ্কগ্রস্ত না হয় সে বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

‘আমি সেখানে গিয়ে বলি যে সেনাবাহিনীর কিছু লোক এটার (হত্যাকাণ্ড) সাথে জড়িত থাকলেও পুরো সেনাবাহিনী এর সাথে জড়িত নয়। সে হিসেবে সেনাপ্রধানের বাণী নিয়ে আমি এখানে আসছি।’ বলছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।

৭ জানুয়ারী ১৯৭২,খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন আওয়ামীলীগের একজন সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।

সামগ্রিকভাবে ১৫ আগস্ট সারাদিন সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ দেখা যায় নি।

অভ্যুত্থানের খবর জানাজানি হবার পরে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেই এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।

তিনি জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। কী করতে হবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

আমিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যখন সকাল হয়ে গেছে তখন দেখা যাচ্ছে কোনও পলিটিকাল ডিরেকশন আসতেছে না। বঙ্গবন্ধু মারা গেছে, এখন আমরা কী করব? কার পেছনে দাঁড়াব? তারা তো খন্দকার মোশতাককে বসিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা তাকে ডিসলজ (ক্ষমতাচ্যুত) করব? এর বিরুদ্ধে গেলে পুরোপুরি যুদ্ধ করতে হবে। কারণ ওরা ট্যাংক বের করে অলরেডি বঙ্গভবনে বসে গেছে, ফার্মগেটের সামনে বসে গেছে, জাহাঙ্গীর গেটের ভেতরে অলরেডি মুভ করছে। পরিস্থিতি অ্যাসেস করতে হচ্ছে। আমরা কি পারব? আমাকে তো জানতে হবে আমার কাছে কত সৈন্য আছে এবং কত অ্যামুনিশন আছে। এতে গিয়া গোলমাল হয়ে গেল। কনফিউশনটা খুব বেশি ছিল।’

খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ঘাতক জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা।

সে থেকে পরবর্তী প্রায় ১৫ বছর বাংলাদেশের ইতিহাস সেনাবাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসনের ইতিহাস।◉

 

 

Share With:
Rate This Article
No Comments

Leave A Comment