সাধারণ মানুষ লক ডাউন চায় কি? সেটাও জানা জরুরি: অমর্ত্য সেন
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, সাধারণ মানুষের কথা শোনা জরুরি। সমাজের আসল চেহারাটা পরিষ্কার থাকলেই করোনা মোকাবিলা সম্ভব। পাশাপাশি পরামর্শ দিচ্ছেন, সরকারি গুদামে মজুত করা চাল–ডাল–গম এখন বিলিয়ে দেওয়া হোক জনসাধারণের মধ্যে। অন্তত এই লকডাউনের দিনগুলিতে যাতে খাবার জোটে তাঁদের।
সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে মতামত রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, করোনা আতঙ্ক কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়। এই লড়াই কিছু মানুষের কাছে দু’বেলা ভাতের সন্ধানের লড়াই। তাঁদের লড়াইয়ে সহযোগী হয়ে উঠতে পারলেই করোনা মোকাবিলা সম্ভব। তাঁদের কী সমস্যা, তাঁরা কী বলতে চাইছেন, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এগুলো জানা খুব জরুরি। অন্তত গণতন্ত্রের স্বার্থে।
অমর্ত্য সেনের মতে, এই ধরনের সামাজিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ভূমিকা খুব জরুরি হয়ে পড়ে।
অমর্ত্য সেন লিখেছেন– ‘ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, ব্রিটিশ শাসনে দেশে প্রায়ই মন্বন্তর দেখা দিত। খেতে না পেয়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতেই আর ভয়াবহ মন্বন্তরের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি দেশে। বাংলায় শেষবার ১৯৪৩ সালে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে। তখন আমি ছোট। সবই নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৪৭–র পর দেশে খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। কারণ একটাই। আমাদের গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের কারণেই মন্বন্তর বা মহামারীর পরিস্থিতিতে সরকারের ওপর সবসময়ে একটা চাপ কাজ করে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সরকার। কারণ তখন সরকারের মাথায় এটাই ঘোরে, পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে না পারলে মানুষ খেপে যাবে। প্রভাব পড়বে ভোটে। তবে শুধুই ভোট দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা সম্ভব নয়। নির্বাচন আসবে। যাবে। ইস্যু বদলে যাবে বা বদলে দেওয়া হবে।
১৯৮৩ সালে ব্রিটেনের নির্বাচনেও তাই–ই হয়েছিল। ১৯৮২ সাল নাগাদ এটা নিশ্চিত ছিল, পরের নির্বাচনে হারছেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরই সব রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গিয়েছিল। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন থ্যাচার। তাছাড়াও, আমাদের ভোটব্যবস্থার যা নিয়ম, তাতেও সরকারের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে চাপ তৈরি হয় না। কারণ মানুষই ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রয়োগ করে পরোক্ষভাবে সরকার তৈরি করে। এখানে জনসাধারণের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ দেখা হয় না।
ফলে সংখ্যালঘু মানুষের দুর্দশার প্রভাব সমাজের সব স্তরের মানুষের ওপর পড়বে, সেটাও বলা যায় না। কিন্তু এটা বাস্তব যে, যেকোনও ধরনের মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন গরিব মানুষেরাই। আর তার প্রতিফলন আমাদের ভোটব্যবস্থায় কখনই দেখা যায় না। তাই গণতন্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষ করে দেশ ও জাতির দুর্দিনে। মানুষকে একে অপরের জন্য আওয়াজ তুলতে হবে। রাজনৈতিক তরজা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারকে শুনতে বাধ্য করতে হবে। সংখ্যালঘুর কথা সরকারের সামনে সংখ্যাগুরুরাও তুলে ধরবে। চাপ তৈরি করবে। তখনই সরকারের গদি টলতে বাধ্য। সরকার সক্রিয় হতে বাধ্য। তখনই রক্ষা পাবে আসল গণতন্ত্র।
এই ধরনের সামাজিক বিপর্যয় কোনও যুদ্ধ নয়, যেখানে সরকারের কথাই শেষ কথা। বরং এই পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে জনসাধারণের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। আলাপ–আলোচনা জরুরি। জনসাধারণের কথা শুনলেই সরকার বুঝবে, এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত! সেরকমই করোনার মতো অতিমারীর ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা প্রযোজ্য। যদিও এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারকে লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তেও যাতে সাধারণ মানুষের সায় থাকে, সেই দিকটিও বিবেচনা করা জরুরি। কারণ এই সময়ে লোকে কাজ হারাবে। অনেকে দু’বেলা খাবার পাবেন না।
তাই এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণের কী চাই, কীভাবে গোটা ব্যবস্থায় তাঁদেরও অংশগ্রহণ করানো যায়, আগে সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এবং তা সম্ভব একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই। করোনার সংক্রমণ রুখতে দেশে লকডাউন জরুরি ছিল। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও বাস্তব যে, এই ঘোষণার পর লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। খেতে পাচ্ছেন না। খাবার কেনার সামর্থ্য নেই কারণ রোজগার নেই।
এই পরিস্থিতিতে অনাহার, খাদ্যসঙ্কট, এমনকী মন্বন্তরের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। এই পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্যার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে। আমেরিকাও বড় অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের দু’বেলার খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। ভারতও তা পারে। অবশ্যই ভারতের অর্থনৈতিক সামর্থ্য কতটা, তার ওপরও নির্ভর করছে। ফুড কর্পোরেশনের গুদামে প্রায় ছ’কোটি টনের কাছাকাছি চাল–গম পড়ে রয়েছে। এখন সেগুলিও গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেসব শ্রমিকেরা কাজ করতে যান, তাদের দুর্দশা সবচেয়ে বেশি। এক তো তাঁদের চোখে মুখে করোনা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দুই, থাকার জায়গা নেই। কাজ নেই। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার নেই। তাঁদের জন্যেও কিছু করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁদের কথা শোনা খুব জরুরি। আসল সমস্যা কোথায়, সেটা না জানা থাকলে কোনও সরকারি সিদ্ধান্তেই কাজ হবে না। গরিবের কথা শুনতে হবে সরকারকে। তার জন্য শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকাটাও জরুরি। সরকারের কাছে আসল চিত্রটা পরিষ্কার থাকলেই এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা সম্ভব।’◉
আজকাল