ইতিহাস গড়তে চলেছেন যে পাঁচ নারী
জাহান আরা দোলন
১৯৮০ এর শেষে ইতিহাসে নারীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে প্রতি মার্চে উইমেনস হিস্টোরি মান্থ-এর ঘোষণা দেওয়া হয়।
চার দশকের ব্যবধান নারীরা এখন দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বাধা অতিক্রম করে খেলাধুলা, বিনোদন, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ইতিহাস তৈরি করছে।
বিশ্বের চোখের সামনে ইতিহাস তৈরি করছেন এমন পাঁচ জন নারীর উল্লেখ করা হয়েছে এখানে।
১.আমান্ডা গরম্যান
তরুণ কবি লরিয়েট আমান্ডা গরম্যান ২০ জানুয়ারী, ২০২১-এ রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
আমান্ডা গরম্যান জানান, তিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তির নিমন্ত্রণ পেয়ে ‘ভীষণরকম অবাক’ হয়েছিলেন, যদিও সেদিনের সে অনুষ্ঠানে আমান্ডা গরম্যানই সমস্ত আমেরিকাকে ভীষণভাবে অবাক করে দিয়েছিলেন।
বাইশ বছরের তরুণী গরম্যান তার কবিতার মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দ্যুতি ছড়িয়ে ছিলেন। কবিতাটি তিনি ৬ জানুয়ারী, আমেরিকার ক্যাপিটল ভবন আক্রমণের রাতে লেখা শেষ করেছিলেন।
গরম্যান জানান, কমলা হ্যরিসকে জাতির প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণের মতো একটি ঐতিহাসিক উদ্বোধনে তিনি তার কবিতা পাঠ করেছেন, তিনি ২০৩৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরিকল্পনা করেছেন।
অপরাহ উইনফ্রে ২০ জানুয়ারী ২০২১ টুইটারে টুইট করেন, ‘আরেকজন তরুণ নারীর জাগরণে আমি কখনোই এতটা গর্বিত বোধ করিনি। সাবাশ। মায়া অ্যাঙ্গেলু আনন্দিত, এবং আমিও ভীষণ আনন্দিত।
উদ্বোধনের পর থেকেই, লস এঞ্জেলেস’র স্থানীয় হার্ভার্ড স্নাতক গরম্যান ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার পেয়েছেন, আইএমজি মডেলদের সঙ্গে সাইন করেছেন এবং তার পরবর্তী বইগুলো প্রকাশের তারিখ ঘোষণার আগেই অ্যামাজনের বেস্ট সেলার তালিকার শীর্ষস্থান দখল করেছে।
২.চিফ মাস্টার সার্জেন্ট জোঅ্যানি এস বেস
চিফ মাস্টার সার্জেন্ট জোঅ্যান এস ব্যাস বিমান বাহিনীর উনিশতম চিফ মাস্টার সার্জেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি বর্তমানে সেকেন্ড এয়ারফোর্সের কমান্ড চিফ মাস্টার সার্জেন্ট হিসেবে প্রতি বছর কিসলার এয়ারফোর্স বেসের তের হাজার তালিকাভুক্ত, কর্মকর্তা, বেসামরিক, ঠিকাদার এবং ছত্রিশ হাজার বেসিক সামরিক প্রশিক্ষণার্থীদের সাহায্য করছেন।
চিফ মাস্টার সার্জেন্ট জোঅ্যানি এস বেস জুনে বিমান বাহিনীর উনিশতম চিফ মাস্টার সার্জেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সামরিক বিভাগের সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত ননকমিশন্ড প্রথম নারী সদস্য হিসাবে ইতিহাস গড়ে ছিলেন।
১৯৯৩ সালে বিমান বাহিনীতে জয়েন করা ব্যাস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এয়ার ফোর্সের ১৯তম চিফ মাস্টার সার্জেন্ট নির্বাচিত হয়ে এবং আমাদের বিমান বাহিনীর সর্বকালের সেরা লিডারদের পদক্ষেপ অনুসরণ করতে পেরে আমি সম্মানিত এবং গর্বিত। ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আমি কখনোই ভুলব না। আমি এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। আমার পরিবার এবং বন্ধুরা যারা আমাকে এগিয়ে যাওয়ার পথে উৎসাহ যুগিয়েছে আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
গত পাঁচ বছর ধরে সেনাবাহিনীতে নারীরা শুধুমাত্র যুদ্ধকালীন ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন। সম্প্রতি আরও দু’জন নারী সদস্য বেস-এর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদে যোগ দিয়েছেন।
সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল লরা রিচার্ডসন এবং এয়ারফোর্স জেনারেল জ্যাকুইলিন ডি ভ্যান ওভোস্ট এই মাসে চার তারকা বিশিষ্ট কমব্যাট্যান্ট কমান্ড প্রধান হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাইডেন, হ্যারিস এবং ডিফেন্স সেক্রেটারি লয়েড অস্টিনের সঙ্গে এই দু’জন নারী যোগদান করেন।
বাইডেন ৮ মার্চ ২০২১ বলেন, ‘আমরা চাই, দেশকে সেবা করার স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে থাকা আমাদের মেয়ে এবং ছেলেরা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেলদের দেখে ধারণা নিতে পারে’।
৩. ড. কিজমেকিয়া করবেট
ভ্যাকসিন রিসার্চ সেন্টার পরিচালক ড. বার্নি গ্রাহাম এবং ডাঃ কিজমেকিয়া করবেট মেরিল্যান্ডের বেশ কয়েকজন বিধায়কের সাথে করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পিএইচডি করা কিজমেকিয়া করবেট, সারস-কোভ-২ ভ্যাকসিন তৈরিতে পৃথিবীব্যাপী লড়াইয়ের একজন প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ। এবং এমন একজন বিশেষজ্ঞ যিনি মহামারীকে পরাস্তকারী বিজ্ঞানের উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালনকারীদের একজন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নিজের অবস্থান তৈরি করতে চলেছেন।
করবেট, মডার্নার সঙ্গে সম্পৃক্ত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ এর একজন সদস্য। মডার্নার ভ্যাকসিন ডিসেম্বরে মার্কিন ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) থেকে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছিল।
মার্চের ৩ তারিখে করবেট প্রথম শিরোনামে আসেন এনআইএইচে রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কথা বলা বিজ্ঞানী দলের সদস্য হিসাবে। তখনো পর্যন্ত আমেরিকা কোভিডের প্রভাব কিছুই টের পায় নি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২০-এর ৩ মার্চে ড. অ্যান্থনি ফৌসি এবং কিজমেকিয়া করবেটের সঙ্গে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ এর বায়োলজি ল্যাব পরিদর্শন করেন।
করবেট ডিসেম্বরে এবিসি নিউজকে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির সাথে এই অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ তরুণ বিজ্ঞানী এবং বর্ণবাদী মানুষের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের পরিচয়।
করবেট বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছে নিজেকে সামনে আনা জরুরী এবং কথা বলতে হলে পেছনে লুকানোর দরকার নেই। তরুণ বিজ্ঞানী এবং কৃষ্ণাঙ্গরা যাদেরকে পর্দার পিছনে কাজ করতে হয় এবং মূলত যারা ভ্যাকসিনের এই বিশাল প্রচেষ্টায় নোংরা কাজগুলো করেছেন, আমার মনে হয়েছে তাদের সকলের জন্য আমার দৃশ্যমান হওয়া জরুরী ছিল।
৪. এনএফএল এর নারী, এমএলবি
জাতীয় ফুটবল লিগে (এনএফএল), নারীরাই মাঠের ভেতরে এবং মাঠের বাইরে ইতিহাস তৈরি করছেন।
জানুয়ারিতে সুপার বোলে, এনএফএল রেফারি সারা থমাস সুপার বোলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথম নারী হিসাবে ইতিহাস তৈরি করেছেন।
সেই খেলায় ক্যানসাস সিটি চিফের সঙ্গে টাম্পা বে বুকানিয়ার্সের ৩১-৯ এর ব্যবধানে জয়ের সঙ্গে সঙ্গে, বুকানিয়ার্সের সহকারী ডিফেন্সিভ লাইন কোচ লরি লোকস্ট এবং সহকারী শক্তি ও কন্ডিশনিং কোচ মারাল জাভাদিফার বিজয়ী দল সুপার বোল টিমের প্রথম নারী কোচিং স্টাফ হিসাবে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন।
দলের কো-ওউনার ডার্সি গ্লাজার কাসেউইটজ সহ নেতৃস্থানীয় পদে বুকানিয়ার্সের বেশ কয়েকজন নারী রয়েছেন, যারা স্কলারশিপ প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জানুয়ারিতে, ওয়াশিংটন ফুটবল দলের সহকারী কোচ জেনিফার কিং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী কোচ হয়েছেন। মায়া চাকা মার্চে এনএফএল রেফারি হিসেবে ইতিহাস তৈরি করেছেন । ২০২১ মৌসুমে চাকা এনএফএল খেলা পরিচালনা পর্ষদের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী সদস্য হবেন।
মায়া চাকা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এনএফএল কর্মকর্তা হিসাবে নির্বাচিত হয়ে আমি সম্মানিত। তবে এই মুহূর্তটি ব্যক্তিগত অর্জনের তুলনায় অনেক ব্যাপক। এটি সমস্ত নারীদের, আমার সম্প্রদায়ের এবং আমার সংস্কৃতির একটি অর্জন।’
মেজর লীগ বেসবল (এমএলবি) এ, কিম এনজি এমএলবি ইতিহাসের প্রথম নারী এবং প্রথম এশিয়ান আমেরিকান জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে ইতিহাস তৈরি করেছেন।
মায়ামি মারলিন্সের জেনারেল ম্যানেজার এনজি’র বেসবলের ক্যারিয়ার ত্রিশ বছরের। এবং চাকরির অফার পাওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে মারলিন্স পজিশনের জন্য ‘বহুবার’ সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে।
এনজি নভেম্বরে ‘জিএমএ’কে বলেন, ‘এটা কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের বিষয় এবং নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস রাখার বিষয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, হাল ছাড়া চলবে না।’
৫. হুইটনি উলফ হার্ড
বাম্বল প্রতিষ্ঠাতা হুইটনি উলফ হার্ড তার এক বছরের ছেলে বো’কে ধরে রেখে এগারো ফেব্রুয়ারী, ২০২১-এ নাসডাক বেল বাজান।
ফেব্রুয়ারিতে, বাম্বল প্রতিষ্ঠাতা হুইটনি উলফ হার্ড বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নার নারী উদ্যোক্তা এবং সবচেয়ে কম বয়সী নারী সিইও যিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি সংস্থাকে পাবলিক করে তোলেন, এবং তিনি তার ছোট্ট ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই কাজটি করেন।
৩১ বছরের উলফ হার্ড খুব লক্ষণীয়ভাবে তার এক বছরের ছেলে ববি লি ‘বো’ হার্ড -কে ধরে রেখে, নাসডাক প্রকাশিত সংস্থাটি নেওয়ার জন্য বোতাম টিপেছিলেন। বাম্বল ইনস্টাগ্রামে সেই মুহুর্তের একটি ছবি শেয়ার করে ক্যাপশন দিয়েছে, ‘নেতৃত্ব এমনই হওয়া উচিত।’
উলফ হার্ড টিন্ডার থেকে হঠাৎ করে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে ২০১৪ সালে বাম্বল প্রতিষ্ঠা করেন। টিন্ডার ছিল একটা ডেটিং অ্যাপ এবং তিনি টিন্ডারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
নারী পরিচালিত পরিচালনা পর্ষদ ছাড়াও, উলফ হার্ড অস্টিন ভিত্তিক সংস্থাটিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারীদের ক্ষমতায়নে ফোকাস করেন। এই ডেটিং অ্যাপ কোম্পানির অন্যতম স্লোগান নারীদের জানায় ‘মেইক দ্য ফার্স্ট ম্যুভ’।
উলফ হার্ড টুইটারে টুইট করেছিলেন ‘যাদের মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে সেইসব নারীদের, যারা আমাদের অ্যাপের মাধ্যমে ১৭ কোটিরও বেশি তাদের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং ব্যবসায়িক বিশ্বের সেইসব অগ্রগামী নারী যারা আমাদের পথকে সুগম করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ।’❐
এবিসি নিউজ অবলম্বনে