ইরফান খানের চলচ্চিত্র স্বাক্ষর
ইরফান খান এখন বলিউড তো বটেই, ব্রিটিশ ভারতীয়, হলিউড এবং তেলেগু ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক নাম। ৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি ৫০টির বেশী হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অভিনয় করেছেন হলিউডের চলচ্চিত্রেও। তার অভিনীত ‘লাইফ অব পাই’ অস্কার পেয়েছিল।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারটি ফিল্মফেয়ারসহ অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার। চলচ্চিত্র সমালোচক, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী বলে গণ্য করেন। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে দেশটির চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত করে।
দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আজ বুধবার মারা যান অভিনয় শিল্পী ইরফান খান। মায়ের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই বলিউডকে বিদায় জানান তিনি। মঙ্গলবার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃত্যুকালে ইরফান খানের ৫৩ বছর।
অসুস্থ অবস্থাতেও ইরফান খান তার শেষ সিনেমা ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এ নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। ইরফানের মৃত্যুতে ভারত হারাল এক দক্ষ অভিনয় শিল্পী। ডার্ক শেডের চরিত্র থেকে আজ বলিউডের সেরা অভিনয় শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন ইরফান।
ইরফান খানের বলিউডে অভিষেক হয়েছিল শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারে মনোনীত হওয়া ‘সালাম বম্বে’ ছবির মাধ্যমে। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৮
সালে। কিন্তু কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও তিনি ব্যর্থ হন। এরপরে ২০০৩ সালে অভিনয় করেন ‘হাসিল’-এ। ‘হাসিল’ চলচ্চিত্রটির জন্য শ্রেষ্ঠ খল অভিনয় শিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান ইরফান খান।
এক নজরে ইরফানের সেরা ছবিগুলো-
মকবুল: ২০০৪ সালে বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত ক্রাইম ড্রামাতে অভিনেত্রী টাবুর সঙ্গে অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রটি শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের ভারতীয় সংস্করণ।
রোগ: ২০০৫ সাল। হিমাংশু পরিচালিত ‘রোগ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই প্রধান চরিত্র নিয়ে বলিউডে অভিষেক হয়েছিল ইরফানের।
নেমসেক: ২০০৬ সালে অভিনয় করেন ‘নেমসেক’ চলচ্চিত্রে ভিন্নধর্মী এক চরিত্রে অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই ইরফান দর্শকদের মনে জায়গা করে নেন। টাবুর বিপরীতে অভিনয়ও দর্শকদের নজর কেড়েছিল। এম আইটি থেকে পাস করা এক ভারতীয় ব্যক্তির প্রবাসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যে যুদ্ধ তাই সিনেমাটির মূল বিষয়বস্তু।
ডা ভিঞ্চি কোড: ২০০৬ সালে হলিউডে টম হ্যাঙ্কসের সঙ্গে অভিনয় করেন ডা ভিঞ্চি কোড চলচ্চিত্রে।
লাইফ ইন আ মেট্রো: ২০০৭ সালে অনুরাগ বসুর চলচ্চিত্র ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ বক্স অফিস হিট করে। মন্টির চরিত্রে ইরফানের অভিনয় প্রশংসা পেয়েছিল।
স্লামডগ মিলিওনিয়ার: ইরফানের কেরিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার।’ ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া পরিচালক ড্যানি বয়েলের এই বিখ্যাত চলচ্চিত্রে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইরফান। এই চলচ্চিত্র অস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার জিতে নিয়েছে।
লাইফ অফ পাই: ২০১২ সালে অ্যাডভেঞ্চার সিনেমা ‘লাইফ অফ পাই’ একটি মাস্টার পিস চলচ্চিত্র। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে অভিনয়ের মধ্যে ঢোকেন। অস্কার পাওয়া এ চলচ্চিত্রটি কানাডার লেখক ইয়ান মার্টেলের বুকারজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে। পরিচালক অ্যাং লি।
দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান: ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া হলিউডের স্পাইডারম্যান সিরিজের এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
পান সিং তোমার: ২০১২ সালে তিগমাংশু ধুলিয়া পরিচালিত এই ছবিতে খেলোয়াড়ের চরিত্রে নজর কেড়েছিলেন ইরফান।
সাহেব বিবি অর গ্যাংস্টার রিটার্নস: ‘সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার’-এর সিক্যুয়েল এই ছবি। ২০১৩ সালে রোমান্টিক থ্রিলার ‘সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার রিটার্নস’-এ দারুণ অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান।
দ্য লাঞ্চবক্স: ২০১৩ সালে পরিচালক ঋতেশ বার্তা পরিচালিত ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ ছবিটি ইরফানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র। কান চলচ্চিত্র উৎসবেও ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে ক্রিটিকস উইক ভিউয়ারস চয়েস পুরস্কার জিতেছিল এ চলচ্চিত্র। ২০১৩ সালে টরেন্টো চলচ্চিত্র উৎসবেও এ চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছিল।
পিকু: ২০১৫ সালে সুজিত সরকার পরিচালিত ‘পিকু’ ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের নজর কেড়েছিলেন ইরফান। দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে অতি সাদামাটা অভিনয় করেও দাগ কাটেন। এ চলচ্চিত্রে একজন ট্যাক্সি ব্যবসায়ীর চরিত্রে অভিনয় করেন ইরফান খান।
জুরাসিক ওয়ার্ল্ড: ২০১৫ সালে হলিউডের বিখ্যাত জুরাসিক সিরিজের চলচ্চিত্র ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’-এ অভিনয় করেন।
মাদারি: সালটা ২০১৬। পরিচালক নিশিকান্ত কামাতের পরিচালনায় থ্রিলার ছবিতে ফাটিয়ে অভিনয় করেছিলেন ইরফান। ছবিটি দর্শকমনে আলাদা জায়গা তৈরি করেছিল। সরকারের অবহেলার কারণে ছেলেকে হারিয়ে নির্মল কীভাবে তার প্রতিশোধ নেবে সেটাই ছবির মূল বিষয়বস্তু ছিল।
ডি ডে: ২০১৬ সালে স্পাই থ্রিলার নিয়ে দারুণ এক গল্প নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ডি ডে’তে অভিনয় করে ঝলসে উঠেছিলেন ইরফান।
হিন্দি মিডিয়াম: ২০১৭ সালে সাকেত চৌধুরী পরিচালিত ‘হিন্দি মিডিয়াম’ একটি কমেডি ড্রামা। ইরফান খান এ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে সেরা অভিনয় শিল্পী ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।
কারিব কারিব সিঙ্গল: ২০১৭ সালে পরিচালক তনুজা চন্দ্র পরিচালিত ‘কারিব কারিব সিঙ্গল’ ছবিতেও যোগীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান।
ব্ল্যাকমেইল: ‘ব্ল্যাকমেইল’ ছবিটি ২০১৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল। মূল চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান। তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন সমস্ত দর্শক। দেব কৌশলের চরিত্রে অভিনয় করে নেটিজেনদের মন কেড়েছিলেন অভিনেতা।
পাজল: ২০১৮ সালে আমেরিকান ‘পাজল’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ইরফান। এর গল্প লিখেছেন মার্ক মুভারম্যান ও পলি ম্যান। এটি ২০১০ সালে নির্মিত আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্র ‘পাজল’-এর রিমেক। পরিচালনা করেছেন মার্ক টার্টলটাব। ইরফান খানের বিপরীতে অভিনয় করেন হলিউডের ক্যালি ম্যাকডোনাল্ড।
আংরেজি মিডিয়াম: বলিউড অভিনেতা ইরফান খান অভিনীত কমেডি ড্রামা ‘হিন্দি মিডিয়াম’-এর সিক্যুয়েল এই ছবি। এই ছবি দিয়েই বহুদিন পর বড়পর্দায় ফিরেছেন ইরফান খান। অনেক অসুস্থতার মধ্যেও নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন ইরফান। বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবনে এটাই তার শেষ ছবি।
দেখুন দ্য গার্ডিয়ানের তৈরি ভিডিও ক্লিপ ‘দ্য লাইফ অব পাই টু দ্য লাঞ্চবক্স’