মোখার আঘাত আজ
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ জলভাগে একটানা ৭২ ঘন্টা প্রলয়ংকরী শক্তি সঞ্চয় করে গতকাল শনিবার শেষ রাতে উপকূলে পৌঁছেছে। আজ সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ কক্সবাজারের টেকনাফ ও রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দরের মাঝদিয়ে ভূ-ভাগে আঘাত হানতে শুরু করবে। দুপুরের দিকে মোখা’র মুখ উঠে আসবে ডাঙ্গায়। ঘূর্ণিঝড়টি ৬ থেকে ৮ ঘন্টাব্যাপী প্রায় ৫শ কিলোমিটার জুড়ে তান্ডব চালাবে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া বিশ্লেষকরা।
ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের বুলেটিনে বলা হয়, গতকাল রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ক্যাটাগরি-৫ ক্ষমতাসম্পন্ন সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয় মোখা। ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৯০ থেকে ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা ও ঝড়ো হাওয়া আকারে ২৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উপকূলে আতংক দেখা দিয়েছে। মাইকিং করা হচ্ছে। মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আসছেন। উপকূলের সঙ্গে মোখার দূরত্ব কমে যাওয়ার পর কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর ও আশপাশের চরসমুহে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া দফতর। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরসমুহকে ৮ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এক সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, রবিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে শুক্রবার রাত থেকেই কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলায় বিপদাপন্ন জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা শুরু হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে প্রস্তুত সরকার। সবচেয়ে বিপদের সম্মুখিন সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবস্থানরত মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গতকালই নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে অবস্থানরত অন্তত ৮ হাজার ৫০০ মানুষকে সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাস মাত্রার সুপার সাইক্লোন মোকাবিলায় সক্ষম ৩৭টি অবকাঠামোয় নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে পার্বত্য ৫ জেলায় ভূমিধস ও উপকূলবর্তী ছয় জেলায় প্রবল জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মোখা স্থলভাগে উঠে আসার সময় বাংলাদেশের সীমান্তের সেন্টমার্টিনে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাসে সর্বপ্রথম আঘাত করবে। পানির নিচে চলে যাবে সেন্টমার্টিন। তবে মোখা তান্ডব চালিয়ে সরে গেলে আবারো জেগে উঠবে সেন্টমার্টিন। মাত্র আট বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপের মানুষদের জীবন হুমকির সম্মুখীন। তবে প্রস্তুত নৌবাহিনীর ২১ জাহাজ ও হেলিকপ্টার।
সারাদেশে লঞ্চ চলাচল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বিমান বন্দর,চট্টগ্রাম পোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছেন ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, মোখা এরইমধ্যে চরম প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়ে উঠেছে। আজ রোববার উপকূলে আঘাত হানার আগে এই ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি আরও বাড়াবে। ঝড়টি উপকূলে পৌঁছানোর পর এটি ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, স্থলভাগে উঠার সময় মোখার গতি কিছুটা কম থাকবে। তখন হয়ত সিভিয়ার সাইক্লোন থাকতে পারে বা এর কমবেশি হতে পারে। বাতাসের গতি ১০০-১৫০ কিলোমিটার থাকতে পারে। ঘূর্ণিঝড় মোখার ব্যাস ৫০০ কিলোমিটারের বেশি হওয়ায় এর অগ্রভাগের প্রভাব অনেক এলাকায় পড়বে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়বে যেসব এলাকায়
বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনকেই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়া অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো.আসাদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে। কিন্তু এটা যখন আছড়ে তীরে পড়বে, এটার ক্লাউড মাস্ক বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে, যার প্রভাব সিলেট পর্যন্ত চলে যাবে, তাই সেখানেও প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।এর সঙ্গে পাহাড় ধসের শঙ্কাও বাড়বে। একটানা আট ঘণ্টার বেশি প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধ্বসের আশংকা থাকে। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমি ধস হতে পারে।
পানির নিচে চলে যাবে সেন্টমার্টিন
আবহাওয়াবিদদের তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় মোখা সরাসরি আঘাত হানবে সেন্টমার্টিন ও মিয়ানমার উপকুলে। কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার পূর্বাভাস মডেল বিশ্লেষন করে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা স্থলভাগে প্রথম আঘাত করবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। মাত্র আট বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপের মানুষদের জীবন হুমকির সম্মুখীন। যারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ ত্যাগ করতে পারেননি তাদের ভাগ্য অনিশ্চিত। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক বিজ্ঞানী ড. আবদুল মান্নান বলেন,মোখার প্রভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পানির নিচে চলে যাবে, এটা নিশ্চিত। তবে সেটা স্থায়ীভাবে নয়। শুধু জলোচ্ছ্বাস নয়, আজ পর্যন্ত সেন্টমার্টিনে অমাবস্যার ভরা জোয়ার। মোখা উপকূলে আসার সাথে সাথেই জলোচ্ছ্বাস শুরু হবে। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস একসাথে হলে উচ্চতা বেশি হয়। অর্থাৎ সেন্টমার্টিনে আজ ৩.১ মিটার জোয়ার হবে অর্থাত্ ১০ ফুটের মতো। এর বাইরে জলোচ্ছ্বাস হবে আরও পাঁচ থেকে সাত ফুট উচ্চতার। সুতরাং জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মিলিয়ে ২০ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর সেন্টমার্টিনে এ উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো দ্বীপটি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তবে পানি দ্রুত বেরও হয়ে যাবে। কারণ, চারপাশে খোলা বিচ। মানে একপাশে দিয়ে আসলেও আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যাবে। এটা আবার স্থলভাগে হয় না।
সারাদেশে লঞ্চ চলাচল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বিমান ওঠানামা এবং চট্টগ্রাম পোর্ট বন্ধ
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে সারা দেশে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ। গতকাল শনিবার বিআইডব্লিউটিএয়ের উপপরিচালক মোবারক হোসেন মজুমদার জানান, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বিমান বন্দরে ওঠানামা বন্ধ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম পোর্টের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।