অস্তাচলে বাংলা থ্রিলারের নবাবি সূর্য
উৎপল আহমেদ
পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা চলছে। কে কত বেশি সময় ধরে পানিতে ডুবে থাকতে পারে—সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন কিশোর কাজী আনোয়ার হোসেন আর তাঁর ভাই সুলতান। দুরন্ত কৈশোরের সেই প্রতিযোগিতায় কাজী আনোয়ার ও সুলতান—দুজনেই পানিতে ডুবে যান। সেদিনই জীবনের শেষ দিন হতে পারত কাজীদার, কারণ সেদিন পানিতে ডুবেই মারা যান তাঁর ভাই সুলতান। কাজীদা বেঁচে যান অল্পের জন্য।
কাজী আনোয়ার হোসেনরা ছিলেন ১১ ভাইবোন। প্রায় প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। বিভিন্ন সাক্ষাত্কার ও তাঁর ছোটবোন মাহমুদা খাতুনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, বাইরের জগৎ কাজীদাকে এতটাই টানত যে স্কুলে পড়ার সময়ই কয়েকবার তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। কখনো পাহাড়ে, কখনো সাগরতীরে, কখনো বনে। ৩/৪ দিন ঘুরে বেড়িয়ে আবার নিজেই ফিরে আসতেন। কাজীদার লেখক হয়ে ওঠা এবং প্রকাশনা ব্যবসায় নামার ইতিহাসটিও চমকপ্রদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করার পর সবাই যখন চাকরি খুঁজছেন, কাজীদা তখন নিজের মতো করে উপার্জনের কথা ভাবছেন। এতটাই স্বাধীনচেতা ছিলেন যে, অন্যের অধীনে চাকরি করা তাঁর পছন্দ ছিল না।
তিনি ঠিক করলেন, চা-বিস্কুটের দোকান দেবেন। দিলেনও তা-ই। বাড়ির বাইরের দিকে এক কোণে তিনি সেখানে ‘বৈশাখী’ নামে চায়ের দোকান দিলেন। একদিন তাঁর বাবা প্রথিতযশা শিক্ষক-সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ছেলের দোকানে গেলেন। কাজী আনোয়ার হোসেনকে তিনি নবাব নামে ডাকতেন। বললেন, ‘নবাব, তুই যে আইএ পড়ার সময় দুটি গল্প লিখেছিলি, সেগুলো খুবই ভালো হয়েছিল। তুই সেগুলো নিয়ে ভেবে দেখতে পারিস। এখন থেকে তুই বরং রহস্য গল্পই লিখতে শুরু কর।’
বলা যায়, বাবার অনুপ্রেরণায় কাজী আনোয়ার হোসেনের জীবন বদলে গেল। তিনি তাঁর গল্প দুটি দিয়ে নতুন একটি সিরিজ শুরু করলেন, নাম দিলেন ‘কুয়াশা’। তার পরের ইতিহাস তো কমবেশি সবারই জানা। কাজী আনোয়ার হোসেন এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন যে, থ্রিলার তাঁকে ভীষণ টানত। তাঁর কৈশোরে, প্রায় ৭৫ বছর আগে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ঘটোত্কচ, যকের ধন, আবার যখের ধন, নৃমুণ্ডু শিকারী ইত্যাদি থ্রিলার বই তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। তারপর একদিন হাতে পেলেন রবিনহুড। রবিনের মৃত্যুতে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলেন। রবিনের বীরত্ব, সাহস, নেতৃত্ব, বিপদগ্রস্ত ও ভাগ্যাহতদের প্রতি দুর্বলতা, গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতা, নারীর প্রতি সম্মান—এসব গুণের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
তিনি জানান যে, ‘কুয়াশা’ লেখার পর তিনি জেমস বন্ড সিরিজের ডক্টর নো বইটি পড়েন। বইটি পড়ার পর একাধারে চমত্কৃত, লজ্জিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কাজীদা। নাহ। তখনই তাঁর মনে হয়, লিখলে ঐ রকম বিশ্বমানের থ্রিলারই লিখবেন! পড়তে শুরু করলেন বিভিন্ন বিদেশি বই। কাহিনী সাজাতে ১৯৬৫ সালে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে এলেন চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। এরপর সাত মাস সময় নিয়ে লিখলেন ধ্বংস পাহাড়। এরপর ১০ মাস সময় নিয়ে লেখা হলো ভরতনাট্যম। এভাবেই তাঁর জীবনে আসে সবচাইতে বড় টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৬৬ সালের মে মাস। প্রজাপতির প্রতীকসংবলিত সেবা প্রকাশনী থেকে বের হলো বাংলা প্রকাশনা জগতের প্রথম পেপারব্যাক। কুয়াশা সিরিজের তিনটি বই। তারপরই এলো ধ্বংস পাহাড়, যার নায়ক মাসুদ রানা। প্রথম বাংলা মৌলিক স্পাই থ্রিলার উপন্যাস, প্রথম বাঙালি আন্তর্জাতিক গুপ্তচর বা স্পাই চরিত্র। বলা যায় একটা হইচই পড়ে গেল দেশের পাঠকসমাজে। একে তো স্পাই, তার ওপর আছে যৌনতা! কাজীদার মতে, শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ বা বেশির ভাগই কিন্তু বলল যে ভালো হচ্ছে। আর ৩০ ভাগের মতে, জঘন্য। বেশির ভাগ যখন নিচ্ছে তখন তিনিও লিখে গেলেন। এই সিরিজের বই স্বর্ণমৃগ বের হওয়ার পর তো বিষয়টা গড়াল আদালত পর্যন্ত। নিষিদ্ধ হলো বইটি। তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল তড়তড়িয়ে। পাঠকের কাছ থেকেও তাড়া আসতে লাগল নতুন বইয়ের। যেখানে বাঙালির তো বৈশ্বিক গুপ্তচরবৃত্তির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, সেখানে এ ধরনের বই লেখা কী করে সম্ভব? তাই শুরু হলো ‘বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে’ বা ‘বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে’ লেখা, যার প্রথমটি হলো স্বর্ণমৃগ। সেই থেকে চলছে।
মাসুদ রানার কাহিনী সংগ্রহ করা হয়েছে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, রবার্ট লুডলাম, উইলবার স্মিথ, ইয়ান ফ্লেমিংসহ অসংখ্য বিদেশি লেখকের বই থেকে। মূল কাহিনীর কাঠামোকে সামনে রেখে অনেক ক্ষেত্রেই এদিক-ওদিক ও চরিত্র সংযোজন-বিয়োজন করে দাঁড় করানো হয়েছে মাসুদ রানার প্রতিটি বই। তবে পরবর্তী সময়ে বইগুলো থেকে যৌনতা বাদ দেওয়া হয়। বলা যায়, প্রথম দিককার ৩০-৩৫টা বই বাদে আর কোনোটিতেই যৌনতার তেমন কিছু নেই।
কিন্তু কী করে এলো মাসুদ রানা নাম? কী করে এই সিরিজের অন্যান্য চরিত্রের নাম এলো? তাঁর বন্ধু গীতিকার মাসুদ করিমের নামের প্রথম অংশ ও আর নিজের প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র ‘রানা প্রতাপ’-এর নামের প্রথম অংশ মিলিয়ে ‘মাসুদ রানা’র নামকরণ করেন কাজীদা। সাংবাদিক বন্ধু রাহাত খানের নামে নামকরণ বুড়ো মানে রানার বস মেজর রাহাতের চরিত্রটি। প্রথমে পাকিস্তানি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের আর ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের (বিসিআই) প্রধান তিনি। রানার সহকর্মী ও বন্ধু সোহেল। আর আছে সোহানা চৌধুরী যে শুধু সহকর্মীই নয়, বান্ধবীও। প্রেমিকাও? হয়তো-বা কখনো কখনো। আছে রানার চিরশত্রু পাগল বিজ্ঞানী প্রফেসর কবীর চৌধুরী এবং উ সেন।
তবে কাজী আনোয়ার হোসেনের জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের লেখকস্বত্ব নিয়ে একসময় শুরু হয় প্রবল বিতর্ক। জানা যায়, মাসুদ রানা যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন কাজী আনোয়ার হোসেন দেখলেন তাঁর পক্ষে এককভাবে ‘রানা’ লিখে প্রকাশনার ব্যবসা চালানো খুব কঠিন। এ অবস্হায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘মাসুদ রানা’ লেখানোর উদ্যোগ নেন তিনি। তবে সিরিজের বইগুলো এর স্রষ্টা ও মূল লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের নামেই প্রকাশিত হতে থাকে। ছায়া লেখক হিসেবে অনেকগুলো মাসুদ রানা লেখেন শেখ আবদুল হাকিম। শুরুতে কোনো আপত্তি না থাকলেও ২০১০ সালে শেখ আবদুল হাকিম মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের মালিকানা স্বত্ব দাবি করেন। নয় বছরেও অভিযোগের কোনো সুরাহা না পাওয়ায় তিনি কপিরাইট অফিসে অভিযোগ দায়ের করেন। তিন দফা শুনানি ও দু’পক্ষের যুক্তি-পালটা যুক্তির আলোকে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় কপিরাইট অফিস। সর্বশেষ গত ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ‘মাসুদ রানা’ সিজিরের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’র ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে কপিরাইট অফিসের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেবা প্রকাশনীর প্রধান কাজী আনোয়ার হোসেনের করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে সর্বশেষ এ রায়ের পরেও এই বইগুলোর আসল স্বত্বাধিকারী কে হবেন—সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। এর মধ্যেই গত বছর ২৮ আগস্টে মারা গেছেন বিশিষ্ট লেখক শেখ আবদুল হাকিম। তিনি মারা যাওয়ার ৫ মাস পর গত বুধবার চিরবিদায় নিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
মাসুদ রানা ছাড়াও সেবা প্রকাশনী থেকে কিশোরদের জন্য তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, কুয়াশা সিরিজ, ওয়েস্টার্ন, সেবা রোমান্টিক—কত কিছু যে বের হতো! প্রায় সর্বস্তরের বিভিন্ন রুচির পাঠক তাঁর পছন্দের বইটি খুঁজে পেতেন সেবা থেকে। সেবার সবচেয়ে বড় কার্যক্রম ছিল বিশ্বখ্যাত ক্ল্যাসিকগুলোর অনুবাদ। দামে কম, অনুবাদে অনন্য! সেবা বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ সমাজকে বইমুখি করার ক্ষেত্রে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। ছোটদের জন্য কিশোর পত্রিকা এবং বড়দের জন্য রহস্য পত্রিকা ছিল লেখক তৈরিরও পত্রিকা। আর এসবের জন্য কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম বাংলাদেশের পাঠককুল কখনো ভুলবে না।