আমেরিকায় করোনার যুদ্ধের আরেক সৈনিক সীমা সুস্মিতা
আমেরিকায় এখন যুদ্ধটা চলছে মৃত্যুর সঙ্গে। করোনাভাইরাসের সঙ্গে সে যুদ্ধ চলছে। জীবনের পক্ষ নিয়ে যারা যুদ্ধ করে চলেছেন, তাঁদের মাঝে আছেন বাংলাদেশের যোদ্ধাও। আছেন নিউ ইয়র্কেও। তাঁদেরই একজন সীমা সুস্মিতা। করোনার বিরুদ্ধে এক নির্ভীক যোদ্ধা।
আমেরিকায় এখন সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটি যারা করেন, তারা হলেন হাসপাতালের কর্মী। আর তাঁদের কাজের জায়গাটি হলো হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। আর যদি সে হাসপাতালটি হয় নিউ ইয়র্কে তাহলে বুঝতে হবে তাঁদের দুঃসাহসিক সে লড়াইয়ে তাঁদের মূল প্রতিপক্ষ ‘মৃত্যু।’ আর এই মৃত্যুপক্ষের সেনাপতিটির নাম- করোনাভাইরাস।
সীমা সুস্মিতা একজন নার্স। কিন্তু এখন হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, নার্স কিংবা অন্য পেশার মানুষদের আলাদা পরিচয় লোপ পেয়েছে। তাঁরা সকলেই এখন প্রতিপক্ষ সেনাপতি করোনার নেতৃত্বে মৃত্যুযুদ্ধের বিপরীতে একেকজন যোদ্ধা।
গেল বিশ মাস ধরে কুইন্স হাসপাতালে কাজ করছেন সীমা। সেখানে তাঁর দায়িত্বটি জরুরি বিভাগে। স্থানীয় ভাবে যার পরিচিতি ‘ইমারজেন্সি রুম।’ মার্চের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম যখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণ হলো নিউ ইয়র্কে, তার প্রধান ধাক্কাটি ঢেউয়ের মতো এসে পড়েছিল ইমারজেন্সি রুমে। রোজ শত শত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে আসতে লাগল ইমারজেন্সি রুমে। দিশাহারা হয়ে উঠল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন সীমা সুস্মিতা আর তাঁর সহকর্মীরা।
একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছে, স্টেচারে করে আসছেন অগণিত করোনা আক্রান্ত মানুষ। তাঁদের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে সীমা সুস্মিতা আর তাঁর সহকর্মীদের। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সীমা সে দৃশ্য কখনও ভুলতে পারবেন না। যেদিকে চোখ যায় শুধু রোগী আর রোগী। হাসসপাতালের যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন শুধু রোগী আর রোগী । এত এত অসহায় মানুষ আর দেখেন নি সীমা। সে অসহায় মানুষদের ভিড়ে দেখেছেন অনেক চেনাজানা বাংলাদেশি মানুষদেরকেও। তাঁদের অনেকে মারা গেছেন। অনেকে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন। ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক স্বপন হাই, ছিলেন করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে ওঠা সাংবাদিক ফরিদ আলম, ছিলেন আরও অনেকে। অনেকের নাম মনে নেই; আবার অনেকের নাম জানেনও না সীমা।
তাঁদের সকলেরই আপন দায়িত্ববোধে সেবার ব্যবস্থা করেছেন সীমা। সাহস যুগিয়েছেন তাঁদের। সহযোগিতা করেছেন সাধ্যমতো। যেমন কেউ একজনের দরকার পড়ল নিকটজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলবার। সীমা ব্যবস্থা করে দিলেন। ওই দুঃসময়ে এটুকু সহযোগিতা যে অনেক অর্থ বহন করে, সে খবর রাখেন সীমা। পরে দেখা গেল মানুষটি ফোনে কথা বলার পর ফেসবুকে জানিয়ে দিল সে খবর। তখন কাছে-দূরে তার স্বজন-বন্ধুরা আশ্বস্ত হলেন।
সীমা বলেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়তে নাকি সাহস লাগে। ইমারজেন্সি রুম থেকে রোগীদের সে সাহসই জুগিয়ে গেছেন তিনি।
সীমা সুস্মিতা আরও জানান, এখন সবাই জানে এ অবস্থায় রুচি নষ্ট হয়ে যায়। দেখা গেল, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কারও হঠাৎ পরিচিত কারও মাছভাত খাওয়ার খুব ইচ্ছে হলো। ইচ্ছের কথাটা সীমাকে জানালেন। তার স্বজনেরা টিফিন ক্যারিয়ারে মাছভাত পৌঁছে দিলেন সীমার কাছে। সীমাই সে খাবার নিয়ে এলেন সে রোগীর কাছে। রোগীর চোখেমুখে তখন যে তৃপ্তি, যে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠতে দেখেছেন সীমা, তাতেই তিনি উদ্বেল হয়ে উঠতেন। দিন কয়েক পরই সেই বাংলাদেশী সুস্থ বাসায় ফিরে গেছেন তাঁর পরিবারের কাছে।
‘হাসপাতাল কেবল যন্ত্রণার জায়গা নয়, তৃপ্তি ও আনন্দেরও কিছু পর্ব থাকে,’ বলছিলেন সীমা সুস্মিতা।
কাজ সীমা রাতে বাড়ি রাতে ফিরে যান তাঁর পরিবারের কাছে। রোজ রাতে ফিরতে পারেন না। কখনও কখনও রাত পার করে ভোরে, একটানা ডাবল শিফট শেষ করেন। হাসপাতালের করিডোরে অসহায় মানুষদের করোনার যন্ত্রণা সীমাকে কাতর করে। চোখে ভাসতে থাকে করোনায় পরাজিত হয়ে সদ্য মরে যাওয়া মানুষটির মুখ। এ পরাজয় মরে যাওয়া মানুষটির একলার নয়। সীমারও। সীমার সহকর্মীদেরও। একসঙ্গে এত এত মানুষের মৃত্যু আগে কখনও দেখেন নি সীমা। দেখেন নি আরও অনেকেই। দেখেছে কি কেউ?
তবে ইমারজেন্সি রুমের কাজে কোনও বিরক্তি নেই সীমার। যখনই ডাবল শিফট কাজ করার অনুরোধ আসে, হাসিমুখেই তা মেনে নেন সীমা। বিকেল তিনটে থেকে সকাল সাতটা; করোনার এই আতঙ্কের মাঝেও হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমে টানা ষোল ঘন্টার শিফট করতে ক্লান্তি নেই সীমার।
ব্যক্তিগত জীবনে সীমা সুস্মিতা দু সন্তানের জননী। স্বামী সাংবাদিক দর্পণ কবির। দিনশেষে কঠিন যুদ্ধবিরতিতে সীমা যখন বাসায় ফেরেন, তাঁর দু সন্তান মায়ের অপেক্ষায়। বাংলাদেশে দুশ্চিন্তায় বাবা-মা মেয়ের নিরাপদে বাসায় ফেরার খবরের প্রতীক্ষায়।
কিন্তু সীমা সুস্মিতা একলা নন। সীমার মতো আরও অনেক বাংলাদেশি আছেন যারা ইতিহাসের এই কঠিনতম সময়ে নিউইয়র্কের হাসপাতালে ইমারজেন্সি রুমে কাজ করে যাচ্ছেন। ছড়িয়ে আছেন তাঁরা আমকেরিকা জুড়ে।
তাঁদেরকে রূপসী বাংলার শ্রদ্ধা। অজস্র সীমাদের প্রতি অজস্র শুভকামনা।◉