এল খুশির ঈদ
কদিন আগে বন্ধুস্থানীয় একজন কথায় কথায় বললেন, ‘ভাই, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া একটা লোকও করোনায় মরে নাই‘। আমি খুব বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তার এই একটা বাক্যেই তাকে আমার ভয় করতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে খুব মোলায়েম করে তাকে জানালাম, তার এই ধারণাটি একেবারে সঠিক নয় এবং ভিত্তিহীন। বন্ধুস্থানীয় হলেও তিনি কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার কথাবার্তা পছন্দ করেন। যুক্তিগুলো শোনেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেনে নেন। সেদিনও যখন মেনে নিলেন, আমি বুঝে গেলাম তিনি আসলে কখনোই কোনোকিছু মেনে নেন না। নিজের কাছে পর্যাপ্ত যুক্তি ও তথ্যর অভাবটা উপলব্ধি করে মেনে নেয়ার ভান করেন।
‘ভান’ শব্দটা অভিনয় করা বোঝায়। কিন্তু ‘অভিনয়’ ধনাত্মক। ‘ভান’ ঋণাত্মক। অভিনয় করেন যিনি তিনি শিল্পী। ভান যিনি করেন তিনি কপট ও শঠ। দুঃখজনক হলো এই কপট ও শঠ লোকেরা কি করে যেন সমাজ পরিচালকদের একজন হয়ে যায়। এদের দেখবার-জানবার পর যে কৌতূহলটি জাগে সেটি হলো, এরা কি আগে থেকেই অমন শঠ ও কপট ছিল? নাকি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে এমন করুণ কপট ও শঠ হয়েছে। এর উত্তরটি আগে বিভ্রান্ত ছিল। এখন সহজ হয়েছে। আগেই ছিল। আগে ক্ষমতাহীন ছিল বলে মিইয়ে ছিল। নিজেকে প্রকাশ করে নি বলে বোঝা যায় নি। এখন ক্ষমতা পেয়ে খোলস ছেড়ে বেরুচ্ছে। আরো ক্ষমতা পেলে তখন আর মেনে নেবে না। মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে।
আমাদের জীবনে কিছু নতুন শব্দের ব্যবহার বেড়েছে। চলতে ফিরতে হাঁটতে ঘুমাতে সারাক্ষণ সেসব শব্দের ব্যবহার চলছে। জীবনে নতুন কিছু অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে- সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ইত্যাদি। সারাক্ষণ সকলকে মাস্ক পরবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাধ্যও করা হচ্ছে। সীমিত পরিসরে কাজকর্ম চালাতে বলা হচ্ছে। ঘর থেকে বেরুতে নিষেধ করা হচ্ছে। অফিসের কাজগুলো ঘরেই করতে বলা হচ্ছে।
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে- ফ্যামিলিয়ার। এই যে হঠাৎ করে জীবনে এমন বিশাল একটা পরিবর্তন, মানুষ কি এই পরিবর্তনের সঙ্গে ফ্যামিলিয়ার হয়ে গেছে? নাকি মহামারী করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ফ্যামিলিয়ার হয়ে গেছে? এ প্রশ্নটি বিভ্রান্তি। এ বিভ্রান্তি যতই দিন যাচ্ছে ততই দৃঢ় হচ্ছে যেন।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি বলে একটি ব্যাপার আছে। সহজাত প্রবৃত্তি হলো জন্মগত আচরণ। জন্মগতভাবে সে স্বাধীনচেতা। তাকে কোনোকিছুতে বাধ্য করা কঠিন। বাধ্য করতে গেলে সে বেঁকে বসে। চোখ পাকায়। এরপর প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হয়। এ কারণেই করোনা আবির্ভাবের প্রথম বছরে আমরা দেখেছি লোকেরা সামাজিক দূরত্বর বিষয়টিতে উদাসীন। মাস্ক পরতে রাজি নয়। ঘরে থাকতেও তাদের আপত্তি। রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের ঘরে রাখতে লকডাউন আরোপ করতে হয়। অনেক দেশে কারফিউও জারি করা হয়েছে।
আরেকদল আছে এরা প্রচণ্ডরকম নিয়মতান্ত্রিক। করোনার শুরুতেই এরা বাজার খালি করে ফেলল। বাজারের সকল খাদ্যসামগ্রী আর স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম কিনে ফেলে ঘর বোঝাই করে ফেলল। এদের জন্যে আইন করা লাগল- দুটা বা তিনটার বেশি পেমেন্ট করা যাবে না। এদেরও একটা প্রবৃত্তি আছে। এদের ভুবনটি ক্ষুদ্র। আমি সর্বস্ব।
পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব বছর দেড়েক পেরুলো। শুরুর চিত্রটা সামান্য পাল্টেছে। সেটিকে আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের লোকেরা করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না। একই চিত্র ভারতেও। খবররের কাগজে রোজ খবর পাই, ভারতে কিম্ভুত সব চিকিৎসা পদ্ধতি চলছে। চিকিৎসার সে ব্যবস্থা সুস্থ ধারার লোকেদের কাছে গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। চলছে হাস্যকর চিকিৎসা পদ্ধতিও।
এভাবেই চলতে চলতে ‘এল খুশির ঈদ’। এল পবিত্র ঈদুল ফিতর। মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। গেল বছরের ঈদুল ফিতরে করোনার আগমন সদ্য ছিল। মানুষ বিভ্রান্ত ছিল, ভীত ছিল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল। এ বছরে দুয়ের সহাবস্থানের সময়টা বেড়েছে। গেল বছরের বিভ্রান্তি, ভীতি কিংবা বিমূঢ়তা এবারে নেই তেমন। গেল বছরে করোনা ভারতে তেমন আক্রমণ করতে না পারলেও লকডাউন ছিল। ঈদে মানুষ বেরুতে পারে নি। খবরের কাগজে খবর এসেছে, লকডাউনের ফলে প্রায় দু’মাস নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকেদের কোনো উপার্জন নেই৷ তার ওপর সামাজিক দূরত্বের বিধিতে ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল। এ বছর করোনার আক্রমণে ভারতে পাখির মতো মানুষ মরছে। দিল্লির পার্ককে শ্মশান বানিয়ে লাশ পোড়ানো হচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় চলেছে নির্বাচন উৎসব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারো মুখ্য মন্ত্রী হয়েছেন। চলেছে তার বিজয় উৎসব। হ্যাঁ, সীমিত পরিসরেই।
পাশের দেশ বাংলাদেশে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে যেন ভারত থেকে ভেতরে কেউ ঢুকতে না পারে। ভয়, ভারতের ভাইরাস যেন ঢুকে না পড়ে। ভয়টা অমূলক নয়। সাবধানতাটা দরকার বটে। কিন্তু সে সাবধানতা কাজে লাগে নি। খবরের কাগজের খবরে এসেছে, বাংলাদেশের ছয়জনের শরীরে ভারতের করোনা পাওয়া গেছে। যাবেই। সীমান্ত তালা দিয়ে তো হাওয়া বন্ধ করা যায় না। তাছাড়া ভারতের লোকেদের প্রবেশাধিকার বন্ধ রাখলেও ভারতেও পণ্য তো ঢুকছে। না ঢুকলে চলবে না। সামাজিকমাধ্যমে যতই ভারত বিরোধিতা চলুক বাংলাদেশের বাজারটা তো আসলে ভারত নির্ভর। ভারতের পণ্য না এলে দ্রব্যমূল্য নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। এক ধরনের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যাবে। বেড়ে যাবে মুদ্রাস্ফীতি। মুক্তবাজার অর্থনীতি চলছে তো।
করোনার শুরুতে নানা দেশ নানা দেশের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করেছে। এটা আসলেই দরকারি পদক্ষেপ। কিন্তু পদক্ষেপটা সময়মতো হওয়া চাই। নইলে লাভ কিছু হবে না। চীন থেকে ব্রাজিল আর নিউ ইয়র্কে তো করোনার পৌঁছুতে পারার কথা না। কিন্তু পৌঁছেছিল। নিউ ইয়র্কে দুঃস্বপ্নের মতো মৃত্যুর যে মিছিল চলেছিল তা কি ভুলতে পারব কোনোদিন? পারবে কি কেউ ভুলতে কখনো?
২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কে একাধিক খোলা মাঠ, মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টারে ঈদুল ফিতরের নামাজ হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের আয়োজনটি হয়েছিল টমাস এডিসন স্কুল মাঠে। সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন। কিন্তু পরের বছরই তাতে ভিন্নতা নিয়ে এল করোনা। খবরের কাগজে খবরের শিরোনাম হলো, নিউ ইয়র্কে এল খুশীর ঈদ বিষণ্ণ হয়ে’।
এবারে সে একই চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের মানুষের যায় আসে না। যে দেশের মানুষের কাছে পবিত্র মাহে রমজান মানে খাদ্যবিলাসী হওয়া, যে দেশের মানুষের কাছে ঈদুল ফিতর মানে যেভাবেই হোক, ছলে-বলে-কৌশলে গ্রামের বাড়ি যাওয়া, যে দেশের মানুষ দাঁত বের করে নির্দ্বিধায় বলে দেয়, কিছু হবে না- তাদেরকে নিয়ে বলবার কিছু নেই আসলে।
বলবেনই বা কি করে, আপনি তো এদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন নি। ওর চুলায় হাড়ি না চড়লে আপনি তো চাল নিয়ে তার বাড়ি চলে যাবেন না। জানবেনই তো না। এক কিলোমিটার পথ চলতে প্রায় শ’খানেক ভিক্ষুক এসে হাত পাতে। আপনি বলছেন দেশে ভিক্ষুক নাই। কতশত ছেলেমেয়ে কাজ হারিয়ে কিসব কিসব করছে তার খোঁজ কি রাখেন আপনারা? তাহলে বলবেন কেন? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যারা তারা নিজেরটা নিজেরাই করতে জানে। করেও। সেকারণে দোকান-ভাঙা ছেলেটা পরদিনই একটা বাক্সে সরঞ্জাম তুলে ফুটপাতে বসে পড়ে। চাকরিহারা শ্রমিকটি টুকরিতে সবজি নিয়ে ফেরি করতে নেমে যায়। আপনার বাড়ি-অফিসের সামনে গিয়ে কাজের দাবিতে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলে না।
আর, ‘ভাই, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া একটা লোকও করোনায় মরে নাই’- বলা লোকটা ওয়ার্ড কমিশনার হয়ে বসে। আপনি এদের দৌরাত্ম্য থামান। এরাই মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এদের কারণেই আজকের সমাজে যত অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা।
করোনা কালে দ্বিতীয় ঈদুল ফিতরে সকলকে আন্তরিক ঈদ শুভেচ্ছা।❐
লেখক: সম্পাদক, রূপসী বাংলা ,অনুস্বর ও বাংলা চ্যানেল