‘চারণিক’— স্বপ্ন হলেও স্বপ্ন নয়
মুবিন খান
‘চারণিক’ পত্রিকাটা হাতে নিতেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বুকের ভেতর কোথাও একটা আক্ষেপ চিনচিন করে আপন উপস্থিতি জানাতে লাগল। প্রচ্ছদের ধবধবে সাদা জমিনে একটা অন্ধকার ঘর। সে ঘরের দেয়ালে দুটা জানালা। খোলা। জানালার ওপারে মুক্ত প্রান্তর। ঝলমলে আলো। সবুজ গাছ। ঝিরঝির বাতাস। প্রকৃতি আর প্রাণ। আঁকা নয়, আলোকচিত্র। তাই সকল খুঁটিনাটি ভেসে উঠেছে। ও ছবিতে তাকালে বুক ভরে ওঠে বাতাসে। তারপর যেভাবে বেরিয়ে আসে, তাকে আমরা, মানুষেরা নাম দিয়েছি দীর্ঘশ্বাস! ও ছবিতে আমার লোভ ছিল। আছে এখনও। নিজের ব্যবহারের জন্যে আমিও অমন একটা ছবি চাই। কিন্তু দেখা গেল ‘চারণিক’ আমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে। অগ্রজ তো। ‘চারণিক’কে তাই মাথা নুইয়ে হাত প্রসারিত করে সামনে এগুবার পথটি নির্দেশ করি।
যার প্রচ্ছদ নিয়ে অমন সাতকাহন করা যায়, তার শরীরটি কেমন হবে ভাবুন তো! আমি ভাবি না। প্রচ্ছদ উল্টে ভেতরে ঢুকে পড়ি সুঠাম ক্ষীণকায় চারণিকের। শৈল্পিক ছাপায় পরিচয় হলো চারণিক পরিবারের সঙ্গে। সেখানে জানা গেল, প্রতি তিন মাস অন্তর চারণিক আমাদের সঙ্গে দেখা করবে। জানাবে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ বিষয়ক খোঁজ আর আপন ভাবনা। আমরা চারণিকের সেসব ভাবনা জানতে চাই। তার আগে চলুন বর্তমান ভাবনাটি জেনে আসা যাক।
আমরা কথা বলছি ‘চারণিক’ পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ সংখ্যা নিয়ে। সম্পাদক মাহমুদুল হক আরিফের নান্দনিক রুচির ছাপ ফুটে উঠেছে চারণিকের সর্বাংঙ্গ জুড়ে। সম্পাদনা পর্ষদে আরো আছেন রাশেদ শাহরিয়ার, নূরুল আলম, হোসাইন আনোয়ার ও মোহাম্মদ নিলয়। চারণিকের নান্দনিকতায় তাঁদেরও নিশ্চয়ই সমান ভূমিকা রয়েছে।
এবারে পাতা ওল্টাতে সূচিপত্র। তিনটে প্রবন্ধ, চারটে অণুগল্পর অনুবাদ, আরো তিনটে গল্প আটটি কবিতা একটি অনুবাদ কবিতা আর একটি পাঠ মূল্যায়ন। সূচিপত্রর পাশের পৃষ্ঠাটিতে কিছু নেই। সাদা রেখে দেয়া হয়েছে। এ কাজটি হয়ত করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাবনা থেকে। ভাবনা ঠিক আছে। কিন্তু বই আকৃতির আটচল্লিশ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় চারণিকের জন্যে দৃষ্টিনন্দন বিষয়ক এ ভাবনাটিকে বিলাসিতা বলেই মনে হলো। এই বিলাসিতা অন্তত একজন লেখককে বঞ্চিত করেছে। তাছাড়া অল্প জায়গায় বড় আকৃতির লেখা জায়গা দিতে পত্রিকার সম্পাদকরা অক্ষরদের যেভাবে দু পাশ থেকে নির্দয়ভাবে চেপে ধরেন, ছাপাখানার ভাষায় যাকে কনডেন্সড্ বলা হয়, ওই সাদা পৃষ্ঠাটি অক্ষরদেরকে সে নির্যাতন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারত।
পরের পৃষ্ঠায় ‘চারণিকের আলাপ…’, এ আলাপটি সম্ভবত সম্পাদকীয়র জায়গাটি নিয়ে নিয়েছে। ও আলাপ আমাদেরকে জানায় কোনো এক আড্ডায় জন্ম চারণিকের। উপলক্ষ্যটি সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষদের প্রতি দায়বোধ। এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে চারণিকের দিকে তাকালে মনে হয়, চারণিক যদি ব্যর্থও হয়, তবু শুধু ক’জন তরুণের ওই দায়বোধের কারণেই চারণিক ভীষণভাবে সফল।
চারণিকের পাতা ওল্টাতে শুরুর লেখাটি আর্নস্ট ফিশারের। প্রবন্ধ। শিরোনাম ‘শিল্পকলার ভূমিকা।‘এই লেখকের সঙ্গে পরিচয় আছে। আমরা অবশ্য জানতাম নামটি আর্নেস্ট ফিশার। অস্ট্রিয়ান রাজনীতিবিদ এবং ঔপন্যাসিক। উনিশ শতক শুরুর ঠিক প্রাক্কালে জন্ম। এইখানে নামের বানানের কারণে সামান্য বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কেননা আর্নস্ট ফিশার আরেকজন, নোবেল বিজয়ী জার্মান রসায়নবিদ। অবশ্য প্রবন্ধ পাঠে সে বিভ্রান্তি থাকে না। তবে লেখাটির উপস্থাপন নিয়ে অভিযোগ আছে। আমার মনে হলো, ‘শিল্পকলার ভূমিকা’ প্রবন্ধটির অস্ট্রিয়ান লেখক আর্নস্ট ফিশার নিশ্চয়ই বাংলা ভাষায় তাঁর রচনাটি লেখেন নি! তাহলে যিনি প্রবন্ধটিকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের উপযোগী করে তুললেন, সে মানুষটি কই! তাঁর নাম নেই কেন! একটু পরে দেখা গেল আর্নস্ট ও আর্নেস্ট-এর মতো এও আমারই বিভ্রান্তি। প্রবন্ধর শেষে যেখানে মূল লেখকের বিস্তারিত পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে অনুবাদকের নাম বলে দেয়া আছে। আমার মনে হলো, অনুবাদকের নামটি মূল লেখকের সঙ্গে কিংবা প্রবন্ধর শেষ যেখানটাতে, সেখানে দেয়া হলে তেমন সমস্যা হতো না। পাঠকের চোখে পড়ত। খুঁজতে হতো না। এ প্রসঙ্গে আমরা চারণিকেই প্রকাশিত নূরুল আলমের অনুবাদে ‘বিদেশী ভাষার অণুগল্প’র উদাহরণ টানতে পারি।
মনে রাখতে হবে, আমি মোটেই চারণিককে পরামর্শ দিচ্ছি না। এবং অবশ্যই চারণিককে আমার এ মতামত গ্রহণ করতেও বলছি না। মতামতকে বলে দিতে হয়। তাই বললাম। অন্যকিছু নয়।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি অনুবাদ নয়। লিখেছেন শফিউদ্দিন কবির আবিদ। শিরোনাম ‘পাটকল-চিনিকল বেসরকারিকরণ ও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি।‘ এ প্রবন্ধটি পাঠ না করেও কেবলমাত্র বিষয় নির্বাচনের কারণে প্রবন্ধ লেখক একটি ধন্যবাদ পেতে পারেন। সহজ করে বললে, রাষ্ট্রকে সচল রাখে অর্থনৈতিক কাঠামো। আর অর্থনৈতিক কাঠামোকে সচল রাখে রাষ্ট্রের শিল্পকারখানাগুলো। সরকার লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রের অধীনে থাকা ১৫টি চিনিকলের ৬টি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসা দরকার। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকা এ যুগের মানুষেরা এসব নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী নয়। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ম ও পরচর্চায় উৎসাহী। এই সুযোগে দেশ হয়ে উঠছে আমদানি নির্ভর। পথে বসছে কৃষক। বেকার হচ্ছে শ্রমিক। বাড়ছে ধনী লোকের সংখ্যা। আর হাহাকার করছে মধ্যবিত্তরা।
কৃষকদের ঘাম, রক্ত আর অধিকারের কথাগুলো আদ্যোপান্ত আলোচনা করেছেন শঙ্কর ঘোষ তাঁর ‘ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রাম’ প্রবন্ধে। জানিয়েছেন কৃষকের বঞ্চিত হবার, অধিকার নিয়ে লড়বার ইতিহাস।
দারুণ ঘটনা হলো, চারণিক তিনটি মৌলিক অণুগল্প ছেপেছে। একটি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের ‘অনলাইন শিক্ষা।‘ অপর দুটা মাহমুদুল হক আরিফের ‘হারায়…’ ও ‘নয়ন ভাগা।‘ মাহমুদুল হক আরিফের গল্পর সঙ্গে পরিচয় আছে। গেল বইমেলায় তাঁর অণুগল্পর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটি সংগ্রহে আছে। চমৎকার গদ্য আর ভাষার গাঁথুনি তাঁর। এই গদ্য আর ভাষার গাঁথুনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চারণিক সম্পাদক মাহমুদুল হক আরিফের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। চারণিকের মাধ্যমে পরিচয় ঘটল। গল্পের শুরু করতে একবার মনে হলো, রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতার গদ্যরূপ পড়ছি যেন। বরকত সাহেব হলেন হরিপদ কেরানীর সংসারী সংস্করণ। আসাদুজ্জামান তাঁর গল্পে বর্তমানে খুব প্রচলিত অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর গল্পর জন্যে বরাদ্দ জায়গাটি খুব ছোট না হলেও গল্প বলবার ঢংটি আরও বড় পরিসর দাবি করে বলে মনে হলো। আরেকটি কথা বলা দরকার। ‘বিদ্যুৎ’ শব্দটিকে তিনি ‘কারেন্ট’ লিখেছেন। হয়ত তিনি প্রচলিতের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভুল ব্যবহারটি ছাপার অক্ষরে ছড়িয়ে দিলে ভুলটি প্রতিষ্ঠা পায়। আর ‘শুচিবায়ুগ্রস্ত’কে ‘শুচিবায়ুগ্রস্থ’ লেখাটা লেখকের ভুল না ছাপার ভুল সেটি বোঝা যায় নি।
৪৮ পৃষ্ঠার পত্রিকায় ১২ পৃষ্ঠা কবিতা। পুরো পত্রিকার এক চতুর্থাংশ। কবিতার এই সংখ্যাধিক্য বোধগম্য হয় নি। যেমন বোধগম্য নয় আধুনিক কবিতা। তবে পড়তে ভালো লাগল ক’জনের কবিতা। এখনকার কবিরা নাকি বড় অসহিষ্ণু? তবে নাম না বলাই ভালো। তাঁরা নন, খেপে উঠবেন অন্যরা।
সঞ্জয় কান্তি দাসের লিখেছেন ‘আলতাফ পারভেজের দৃষ্টিতে লুই আলুথুসের রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা।‘ এ রচনাটি একটি পাঠ মূল্যায়ন। আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক বলে পরিচিত। পত্রপত্রিকায় তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখা পড়েছি। আমি জানি না আলতাফ পারভেজের দৃষ্টিতে লুই আলুথুসের রাষ্ট্র দর্শন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। চারণিক সম্পাদক নিশ্চয়ই জানেন। তিনি কি জানাবেন?
চারণিক পত্রিকাটির একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। সে বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করতে এর আলাদা একটা নামও আছে। লিটল ম্যাগ। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাগুলোকে লিটল ম্যাগ নামে ডাকা হয়। হয়ত সে ডাকে আদর আছে, প্রশ্রয় আছে, আছে ভালোবাসা। কিন্তু এ নামটি আমার পছন্দ নয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে এ ধরনের পত্রিকায় যে চর্চাটি করা হয়, তা করা হয় বাংলায়। খাঁটি, শুদ্ধ, পরিশীলিত বাংলায়। তাহলে এর পরিচয়টি কেন ইংরেজি ভাষায় হবে সেটি বোধগম্য নয়।কারণটি আমি জানি না। তাহলে কি ১৮৪৪ সালে রালফ্ ওয়ালডো এমারসন আর মার্গারেট ফুলার ‘ডায়াল’ পত্রিকা দিয়ে যে ধারাটি নির্মাণ করেছিলেন, তার অনুকরণ? আমি জানি না। সেটি যদি হয়, তবে সে ধারাটি কই?
চারণিক কেবলমাত্র ক’জন তরুণের দায়বোধের কারণেই ভীষণভাবে সফল নয়, চারণিক তার সবটুকু নিয়েই সফল। চারণিক এখন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই স্বপ্নটিকে বাঁচিয়ে রাখাটা সম্পাদক মাহমুদুল হক আরিফের দায়িত্ব ও কর্তব্য, ঠিক তাঁর গদ্য আর ভাষার গাঁথুনির মতোই।
ভুল থাকবেই। সে ভুলকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে শুদ্ধতার খোঁজ।❐