মার্কিন নতুন ভিসানীতি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা বেশি চিন্তিত
যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন ভিসানীতি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে চিন্তার আবেশ তৈরি হচ্ছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুশিয়ারিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ রয়েছে। আবার কেউ কেউ আশা করছেন, এতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
জানা গেছে, সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মকর্তাদের অনেকে বিশ্বস্ত ব্যাচমেট ও বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন— জানার চেষ্টা করেছেন কী হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনে যারা কাজ করছেন ও ভবিষ্যতে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের কেউ কেউ সিনিয়রদের কাছে নানাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ চাইছেন।
অনেক কর্মকর্তার সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন এবং সেখানে যাদের সহায়-সম্পদ ও যাতায়াত রয়েছে, এমন কর্মকর্তাই ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুশিয়ারিতে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। তবে প্রশাসনের নিম্ন ও মধ্যস্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। এ দুই স্তরের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুশিয়ারিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, গুটিকয়েক দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভিসানীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করব না। এটা দুটি রাষ্ট্রের ব্যাপার।’ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে কিনা, এমন এক প্রশ্নেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
তবে বিষয়টিকে পাত্তা দিতে নারাজ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সরকারের অতিরিক্ত সচিব এসএম আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা নিয়ে চিন্তার কারণ দেখি না। কারণ নির্বাচনের তফসিল হওয়ার পরই নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব দপ্তর নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। তখন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শতভাগ সততার সঙ্গে কাজ করি। প্রধানমন্ত্রী, ইসি, জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্রও চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। আমরাও চাই সুষ্ঠু নির্বাচন। তা হলে চিন্তার কোনো কারণ দেখি না।’
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। পুলিশ বাহিনীর কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অনেকে আবার সরকারের সিদ্ধান্তকেই তাদের মতামত হিসেবে ব্যক্ত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘আসলে আমরা রাষ্ট্রের দেওয়া দায়িত্ব পালন করি। রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেভাবেই দায়িত্ব পালন করব। এখানে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সুবিধা বা অসুবিধা নেই।’
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মো. মনজুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনকালীন পুলিশ নির্বাচন কমিশনের আওতায় থাকে। সেখান থেকে সেভাবে পরিচালনা করা হবে। পুলিশ তার দায়িত্ব সেভাবেই পালন করবে।’
এদিকে শুক্রবার (২৬ মে) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, নীতিটি ভালো, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এটি বাংলাদেশ সরকারের ওপর কোনো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেনি, যখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক চমৎকার রয়েছে।
তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিকে সমর্থন করে। নতুন মার্কিননীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ মনে করেন, নতুন নীতির ফলে বিএনপির রাজনীতি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি অনুযায়ী নির্বাচন প্রতিহত করার যে কোন কার্যকলাপ বিধি-নিষেধের আওতায় পড়ছে। ফলে নির্বাচন প্রতিহত করার বিএনপি’র কোন উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো ধরনের সহায়তা পাবে না।’
তবে বিএনপি মনে করে, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিএনপিসহ বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ দীর্ঘদিন যাবৎ যে দাবি জানিয়ে আসছিল, পরিবর্তিত মার্কিন ভিসানীতিতে তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা অত্যন্ত গভীরভাবে লক্ষ্য করছি, এই পরিবর্তিত মার্কিন ভিসা নীতিতে শুধুমাত্র পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই আওতাভুক্ত করা হয়নি, সুনির্দিষ্টভাবে বিচারবিভাগ, প্রশাসন, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সরকারি জনবল, সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে চেষ্টা করবে তাদের এবং তাদের পরিবারবর্গকে আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সকল মহলের দাবি ও প্রত্যাশা। তাই চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা জাতীয় সংকট থেকে মুক্তিলাভের এটাই একমাত্র পথ বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কেউ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। দেশটির এ বার্তার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো, আমাদের দেশে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি, নাগরিক সমাজের মধ্যে আলাপ-আলোচনার একটা ক্ষেত্র তৈরি হোক, এটাও যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায়।